দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ | ইতিহাসের ভয়াবহতম অধ্যায়

0
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানব ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে সাড়ে আট কোটির বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিলো।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ 

বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে প্রথম বারের মত বিশ্বযুদ্ধের স্বাক্ষী হয়েছিল মানব সভ্যতা। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী সেই যুদ্ধকে ঐ সময়ের প্রভাবশালীরা “সব সংঘাত বন্ধের যুদ্ধ”ও আখ্যা দিয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে এমন রক্তক্ষয়ী ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে লীগ অব নেশন্স নামক একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনও গড়ে তোলা হয়েছিল। এই সংগঠনটিকে বর্তমান জাতিসংঘের পূর্বসূরী বলা যেতে পারে। তবে ইতিহাসবিদদের ভাষ্য অনুযায়ী, ঐ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিপর্বই পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধের বীজ বপন করে গিয়েছিল। যার ধারাবাহিকতায় মাত্র দুই দশকের মধ্যেই পুরো পৃথিবীজুড়ে আবারো বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল বেজে উঠেছিল। সংগত কারণেই এই যুদ্ধটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামে পরিচিত। এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধটি ছিল মানব ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে পৃথিবীর কমপক্ষে ত্রিশটি দেশের প্রায় দশ কোটি মানুষ সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। আর যুদ্ধ শেষে সব মিলিয়ে প্রানহানির সংখ্যা ছিল সাড়ে আট কোটির বেশী। এর মধ্যে সাড়ে পাঁচ কোটির বেশী ছিলেন বেসামরিক নাগরিক। আর এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাতসীদের দ্বারা নির্বিচারে ইহুদী নিধনের কার্যক্রমটি মানব ইতিহাসের অন্যতম বিষাদপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। হলোকাস্ট শীর্ষক এই জেনোসাইডে কমপক্ষে ৬০ লাখ ইহুদী ধর্মাবলম্বী মানুষকে হত্যা করেছিল নাতসী বাহিনী। আজ আপনাদের এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত জানাবো। 


 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেন শুরু হয়েছিলো?

 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে বিজয়ী মিত্রবাহিনীর নীতি নির্ধারকেরা পরাজিত সাম্রাজ্যগুলোর প্রতি বেশ কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। অস্ট্রো হাঙেরি সাম্রাজ্যটি ভেঙে গোটা দশেক নতুন রাষ্ট্র এবং রাজ্যের সৃষ্টি করেন তারা। আর অটোমান সাম্রাজ্যটি ভেঙে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় বৃটেন এবং ফ্রান্স। এই ভাগ বাটোয়ারা অস্বীকার করে তুরষ্ক নিজেদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আত্মসমর্পন পত্র হিসেবে স্বাক্ষরিত ভার্সাই চুক্তি অনুযায়ী জার্মানীকেও বেশ চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল। প্রথমত রাজ্যটির পশ্চিম সীমান্তবর্তী একাধিক এলাকার নিয়ন্ত্রণ ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামের কাছে হস্তান্তর করা হয়। অণ্যদিকে পূর্ব সীমান্তে বিশাল এলাকা নিয়ে পোল্যান্ড নামক নতুন একটি রাষ্ট্র গঠন করেন বিজয়ী জোটের সদস্যরা। তবে এই কাজ করতে গিয়ে তারা বিপুলসংখ্যক জার্মান নাগরিককে মূল জার্মানী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন। তাছাড়া জার্মান সামরিকবাহিনীর ওপরেও একাধিক বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা এক লাখের নীচে রাখা, ট্যাংক বা কামানের মত কোন ভারী অস্ত্র ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা উল্লেখযোগ্য। এমনকি জার্মানীকে কোন বিমানবাহিনী রাখারও অনুমতি দেয়া হয়নি। সর্বোপরি জার্মানী ও তার মিত্রদের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ বিপুল অংকের অর্থ পরিশোধের নির্দেশ দেয়া হয়। যৌক্তিক কারণেই বিজয়ী জোটের এই অবস্থান জার্মানীর জনসাধারনকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। মিত্রবাহিনীর এমন একপেশে কর্মকাণ্ড জার্মানীর মত ইতালির জনসাধারণের মাঝেও তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করে। যুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনী তাদের পক্ষে লড়াইয়ের বিনিময়ে ইতালিকে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের পূব উপকূলে উপনিবেশ স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ শেষে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি। অথচ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালির প্রায় ছয় লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। এই জনরোষের কারণে বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে জার্মানী এবং ইতালির রাজনৈতিক অঙ্গনে উগ্র ডানপন্থী দলগুলোর উত্থান শুরু হয়।     
 
এসময় ইউরোপের যুদ্ধবিদ্ধস্ত অর্থনীতিগুলোও এই উগ্রপন্থীদের ক্ষমতায়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। বিশেষ করে জার্মানীতে মূদ্রাস্ফীতির তীব্রতা রীতিমত আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছিল। ১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসে এক ইউ এস ডলারের বিনিময়ে চার ডয়েশ মার্ক পাওয়া যেত। পাঁচ বছরের মাথায় ১৯২৩ সালের নভেম্বর মাসে এক মার্কি ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় চার হাজার দুইশো কোটি ডয়েশ মার্কে। এমন অসহনীয় মূদ্রাস্ফীতির কারণে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিপূরণ পরিশোধ বন্ধ করে দেয় জার্মানী। তখন অবশ্য জার্মানী বিশ্বজুড়ে ওয়াইমার রিপাবলিক নামে পরিচিত ছিল। এর প্রতিবাদে ওয়াইমার প্রজাতন্ত্রের সীমান্তে অবস্থিত রূর নামক শিল্প এলাকাটি দখল করে নেয় ফ্রান্স এবং বেলজিয়াম। ১৯২৮ সালে জনসাধারনের মাঝে বিদ্যমান অসন্তোষের সুযোগে ইতালির ক্ষমতায় আসেন মুসোলিনি। সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে দেশটিতে ফ্যাসিবাদ আমলের সূচনা করেন তিনি। এর পরের বছর, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে ওয়াল স্ট্রিট শেয়ার বাজারে বিশাল এক ধস নামে। এর প্রভাবে পুরো বিশ্ব অর্থনীতিতে এক ভয়াবহ মন্দার সৃষ্টি হয়। ইতিহাসে এই মন্দাটি গ্রেইট ডিপ্রেশন নামে কুখ্যাত। এই মন্দার ফলে জার্মানীর অর্থনীতিও সংকুচিত হয়ে পড়ে। ১৯৩২ সালে দেশটির তরুন প্রজন্মের মাঝে বেকারত্বের হার শতকরা ত্রিশ ভাগ ছাড়িয়ে যায়। পরিস্থিতির জন্য সরকারকে দায়ী করে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন জার্মানীর অধিবাসীরা। এর ধারাবাহিকতায় ঐ বছর জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয় উগ্র ডানপন্থী দল এনএসডিএপি। জনৈক অ্যাডল্ফ হিটলার নেতৃত্বাধীন এই দলটি সংক্ষেপে নাতসী পার্টি নামে পরিচিত ছিল। নির্বাচনে জয়লাভের পর দলটি তাদের সভাপতি অ্যাডল্ফ হিটলারকে দেশের সরকারপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করে।      
 
দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পরেই মুসোলিনির অনুকরনে বাকী সব রাজনৈতিক দলকে অবৈধ ঘোষনা করেন হিটলার। ১৯৩৩ সালে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করা বন্ধ করে দেন। এরপর ভার্সাই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাবার ঘোষণা দিয়ে জার্মান সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি শুরু করেন তিনি। শুধু তাই না, সক্ষম জার্মান তরুনদের জন্য সামরিক প্রশিক্ষন বাধ্যতামূলক করা হয়। হিটলারের এই কর্মকাণ্ড নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে কিছুটা সমালোচনা হলেও জাতীয় পর্যায়ে তার জনপ্রিয়তা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ১৯৩৫ সাল নাগাদ হিটলার প্যান জার্মানিজম শীর্ষক একটি মতবাদ উদ্ভাবন করেন। সংক্ষেপে এই মতবাদ অনুযায়ী, বিশুদ্ধ জার্মান বংশোদ্ভূতরা অ্যারিয়ান জাতের সদস্য। এই মতবাদে সোনালী চুল এবং নীল চোখের অধিকারী জার্মানদের বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম জাতি হিসেবেও দাবী করা হয়। এর বিপরীতে হিটলারের ধারণা অনুযায়ী, ইহুদী ধর্মাবলম্বীরা ছিলেন মানুষের মধ্যে নিকৃষ্টতম। এছাড়া কার্ল মার্ক্স প্রণীত সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের অনুসারীরাও হিটলারের নিকৃষ্ট মানুষের তালিকায় স্থান পেয়েছিল। সর্বোপরি, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় একটি চূড়ান্ত সমাধান বাস্তবায়নের প্রস্তাব রাখেন নাতসীবাদের জনক হিসেবে কুখ্যাত অ্যাডল্ফ হিটলার। তার প্রস্তাবনা অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে অ্যারিয়ানদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা হবে। এবং বৈশ্বিক ঐ সাম্রাজ্যে ক্ষমতাসীনরা বিশ্বব্যাপী মার্ক্সপন্থী এবং ইহুদীদের নির্মূলে গণহত্যা চালাবে। নিজের এই ঘৃণ্য সমাধান জার্মানীর ভেতর বাস্তবায়নও শুরু করেছিলেন হিটলার। এদিকে, ১৯৩৫ সালেই আফ্রিকা মহাদেশে নতুন উপনিবেশ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় ইতালি। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পূর্ব আফ্রিকার ইথিওপিয়া রাজ্যে সেনা অভিযান শুরু করা হয়। সেনা হামলার মুখে অ্যাবিসিনিয়া নামে পরিচিত এই রাজ্যের শাসক পালিয়ে যান, তবে রাজ্যটির জনসাধারণ সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করে। একই সময় ইউরোপের স্পেইনেও ক্ষমতাসীন রাজার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান শুরু করেন স্প্যানিশ সেনাবাহিনীর জেনারেল ফ্রান্সিস ফ্র্যাঙ্কো। এই অভ্যুত্থানে জেনারেল ফ্র্যাঙ্কোকে সামরিক সহায়তা দেয় ইতালি এবং জার্মানী। এই সুযোগে ১৯৩৬ সালে নিজেদের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক সামরিক চুক্তিও করে নেয় স্বৈরনায়ক শাসিত এই দেশ দুটো। এই চুক্তিটি রোম-বার্লিন এগ্রিমেন্ট নামে পরিচিত। 
 
একই বছর এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তি জাপানের সাথেও একটি পৃথক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে জার্মানী। প্রথ বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় এই মহাদেশের অবস্থাও খুব একটা ভাল ছিল না। ১৯৩১ সালে প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের সীমানাসংলগ্ন চীনের মাঞ্চুরিয়া প্রদেশটি দখল করে নিয়েছিল জাপানের সেনাবাহিনী। ১৯৩৬ সালে চীনে রাজপন্থী এবং কমিউনিস্টদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে, জাপান মাঞ্চুরিয়ার দক্ষিণেও বিশাল এলাকাজুড়ে সেনা মোতায়েন করে। ১৯৩৭ সালে চীনের নানজিং প্রদেশে জাপানী সেনাবাহিনী বর্বর গণহত্যা চালায়। ইতিহাসে এই ঘটনাটি নানজিং ম্যাসাকার নামে পরিচিত। এতে চীনের প্রায় তিন লাখ নাগরিক জাপানী সেনাদের হাতে প্রাণ হারায়।  ১৯৩৮ সালে জার্মানীর প্রতিবেশী অস্ট্রিয়াতেও নাতসী পার্টি ক্ষমতা লাভ করে। এরপর তারা নিজেদের স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে জার্মানীর সাথে একীভূত হবার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। অস্ট্রিয়ার এই কাজে হিটলার ইউরোপের আরো এলাকা দখলে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে প্রায় ৩৫ লাখ জার্মান অধ্যুষিত চেকোশ্লোভাকিয়া দখলে তিনি চেষ্টা শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৩৯ সালের শুরুতে চেকোশ্লোভাকিয়ার বিশাল এলাকা দখল করে নেয় জার্মান সেনাবাহিনী। জার্মানীর এই আগ্রাসনে সম্মতি ছিল বৃটেন এবং ফ্রান্সেরও। তবে ছয় মাসের মাথায় বৃটেন এবং ফ্রান্সের সাথে সম্পাদিত মিউনিখ চুক্তির শর্ত ভেঙে পুরো চেকোশ্লোভাকিয়াই দখল করে নিয়েছিল জার্মানী। নিজেদের দক্ষিণ পূর্ব সীমান্ত সুরক্ষিত করার পর এবার উত্তর পূবে পোল্যান্ডের দিকে নজর ফেরায় জার্মানী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বাজেয়াপ্ত করা স্থলভাগ ফিরিয়ে দিতে পূর্ব ইউরোপের দেশটিকে আল্টিমেটাম দেন হিটলার। জবাবে বৃটেন এবং ফ্রান্স জানায়, পোল্যান্ড আক্রান্ত হলে তারা জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। 
 
একই বছর অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত আলবেনিয়া দখল করে নেয় ইতালি। আর মঙোলিয়ার সাথে সীমান্তে বিবাদের জের ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে জাপান। ঐ যুদ্ধে পরাজিত হবার পর, নিজেদের পশ্চিমমুখী সম্প্রসারণ বন্ধ করে দক্ষিনে নতুন উপনিবেশ সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করে পূর্ব এশিয়ার এই দেশটি। অবশেষে ১৯৩৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর কোন পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই পোল্যান্ড আক্রমন করে বসে জার্মান সেনাবাহিনী। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এর প্রতিক্রিয়ায় জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বৃটেন এবং ফ্রান্স। এই যুদ্ধে জার্মানী সম্পূর্ণ আনকোরা একটি সমর কৌশল প্রয়োগ করে। ব্লিট্জক্রিগ শীর্ষক এই কৌশলে ট্যাংক এবং অন্যান্য সাঁজোয়া যান ব্যবহার করে শত্রুপক্ষের প্রতিরোধ রেখা খুব দ্রুত ভেঙে ফেলা হয়। তারপর দুপাশের শত্রুকে আলাদা ভাবে ঘিরে ফেলা হয়। জার্মানীর অভিনব এই সমর কৌশলের মুখে পোল্যান্ডের সামরিক বাহিনী তেমন শক্ত কোন প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি। 
 
জার্মানী যখন তার পূব সীমান্তে দখল অভিযানে ব্যস্ত ছিল, তখন বৃটেন এবং ফ্রান্সের যৌথবাহিনী পশ্চিম দিক থেকে জার্মানীর ভেতর ঢুকে পড়ার বদলে দেশটির পশ্চিম সীমান্তে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মত দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের প্রস্তুতি গ্রহন করে। মিত্রবাহিনীর এই ভুলে পশ্চিম পোল্যান্ড জার্মানীর দখলে চলে যায়। এই সুযোগে সোভিয়েত ইউনিয়নও সেনা পাঠিয়ে পোল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলটুকু দখল করে নেয়। পোল্যান্ডের পাশাপাশি ফিনল্যান্ডের সীমান্তবর্তী একাধিক এলাকায় সেনা মোতায়েন করে সোভিয়েতরা। সোভিয়েত হানাদারদের বিরুদ্ধে ফিনল্যান্ডের সেনাদের যুদ্ধটি উইন্টার ওয়ার নামে পরিচিত। সামরিক শক্তির বিচারে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের প্রতিপক্ষ ফিনল্যান্ডের তুলনায় অনেক এগিয়ে থাকলেও, আক্রমনকারীরা এই যুদ্ধে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে দু পক্ষের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের দুর্বলতার বিষয়টি হিটলারের দৃষ্টি আকর্ষন করেছিল। এর ফলে তার মনে সোভিয়েত ইউনিয়ন দখলের তীব্র বাসনা জন্ম নেয়। একই সময় বৃটেন এবং ফ্রান্সের যৌথ নৌবাহিনী নর্থ সির সমুদ্র পথে অবরোধ আরোপ করে। এর ফলে সুইডেন থেকে জার্মানীতে জ্বালানী তেল আমদানী বন্ধ হয়ে যাবার আশংকা সৃষ্টি হয়। জবাবে, জ্বালানী আমদানীর সমুদ্র পথটি নিরাপদ রাখার বাহানায় ১৯৪০ সালের এপ্রিল মাসে ডেনমার্ক এবং নরওয়ে দখল করে নেয় জার্মান সেনাবাহিনী।
 
ঐ বছর মে মাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অনুকরণে নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম এবং লুক্সেমবার্গ দেশ তিনটি দখল করে নেয় নাতসী সেনারা। এ থেকে মিত্রবাহিনীর বৃটিশ এবং ফরাসী সেনা কর্তৃপক্ষ মনে করেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতই শ্লিফেন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে জার্মানী। এই ধারণার কারণে বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডের সেনাবিাহিনীর সাথে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয় মিত্রবাহিনী। কিন্তু জার্মানী তাদের পশ্চিম দিকেও ব্লিট্জক্রিগ রনকৌশল ব্যবহার করে। মিত্রবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যূহের দূর্বলতম স্থানে তারা বোমারু বিমান ব্যবহার করে প্রথমে উপুর্যপুরি কয়েক ঘন্টা গোলাবর্ষণ করে। এরপর সেই ফাক দিয়ে প্যাঞ্জার ট্যাংক এবং সাজোয়া যানের বহর শত্রুপক্ষকে ঘিরে ফেলে। এভাবে বৃটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডের প্রায় ১৫ লাখ সেনা ডানকার্ক সৈকতে আটকা পড়ে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সেখান থেকে প্রায় সাড়ে তিন লাখ বৃটিশ এবং ফরাসী সেনাকে ইংল্যান্ডে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ১৯৪০ সালের চৌঠা জুন ডানকার্ক সৈতকটিও জার্মান সেনাদের দখলে চলে যায়। 
 
এরপর নাতসী বাহিনী ফ্রান্স দখলে অভিযান শুরু করে। দেশটির রাজধানী প্যারিস অভিমুখে বিদ্যুত গতিতে এগিয়ে যায় জার্মান সেনারা। উত্তরে এই অস্থিরতার সুযোগে দক্ষিণ পূব সীমান্ত দিয়ে ফ্রান্সের ভেতর ঢুকে পড়ে ইতালীর সেনাবাহিনী। ফ্রান্সের নবনির্বাচিত সরকার প্রধান মার্শাল বেঁতা দ্বিমুখী এই সাড়াশী আক্রমনের মুখে যুদ্ধবিরতির চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হন। কিন্তু লন্ডনে নির্বাসিত ফরাসী সেনাপ্রধান জেনারেল শার্ল দ্যু গল এক রেডিও বার্তায় ফ্রান্সের জনসাধারণের প্রতি নাতসী বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। মার্শাল বেঁতা তার অনুসারীদের মধ্য থেকে হিটলারপন্থী সরকার গঠন করে দক্ষিণ ফ্রান্সের ভিশি শহরে রাজধানী সরিয়ে নেন। আর ফ্রান্সের উত্তর এবং পশ্চিম প্রান্তে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় নাতসী বাহিনী তাদের নিজস্ব সামরিক শাসন কায়েম করে। এর ফলে ফরাসী নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজগুলো জার্মানীর দখলে চলে যায়। এদিকে, উত্তর এবং পশ্চিমে এই অস্থিরতার সুযোগে পূর্ব ইউরোপের লাটভিয়া, এস্তোনিয়া এবং লিথুয়ানিয়া দেশ তিনটি কোন যুদ্ধ ছাড়াই দখল করে নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন।
 
স্পেন এবং পর্তুগাল ছাড়া ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের পুরোটা নিজের দখলে নেবার পর, ১৯৪০ সালের জুলাই মাসে ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে বৃটেন দখলে যুদ্ধ শুরু করে নাতসী বাহিনী। কিন্তু বৃটিশ নৌবাহিনীর শক্তি মোকাবেলার সামর্থ্য না থাকায়, ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে বিমান হামলা চালিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। রয়্যাল এয়ারফোর্স এবং জার্মান বিমানবাহিনীর মধ্যে এই যুদ্ধটি ইতিহাসের পাতায় ব্যাটল অভ বৃটেন নামে স্থান করে নিয়েছে। প্রথম দিকে এই যুদ্ধে জার্মান বিমানবাহিনী শুধু মিত্রবাহিনীর সামরিক স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করেই বোমা হামলা চালাতো। কিন্তু আগস্ট মাসে এমন একটি হামলায় ব্যবহৃত বোমাটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হরেয় লন্ডনের উপকণ্ঠে এক জনপদে আঘাত হানে। এর জবাবে খোদ বার্লিন শহর লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালায় বৃটিশ বিমানবাহিনী। যা হিটলারকে ভীষণ ক্ষূব্ধ করে তোলে। এরপর থেকে সামরিক স্থাপনার বদলে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহর লক্ষ্য করেই বোমা বর্ষণ শুরু করে জার্মানী। সব মিলিয়ে ১৯৪০ সালের ১০ই জুলাই থেকে শুরু হয়ে ৩১শে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় চার মাস স্থায়ী এই আকাশ যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত বৃটিশ বিমানবাহিনীই জয়লাভ করে। কিন্তু উভয় পক্ষেই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। বৃটিশ বিমানবাহিনীর দেড় হাজারের বেশী পাইলট এই যুদ্ধে প্রাণ হারান। আহত হন আরো প্রায় পাঁচশো জন। আর শত্রুপক্ষের হামলায় বিধ্বস্ত বিমানের সংখ্যা এক হাজার সাতশো চুয়াল্লিশটি। এর বিপরীতে জার্মান বিমানবাহিনীর আড়াই হাজারের বেশী পাইলট এই যুদ্ধে নিহত হন। আহত হয়েছিলেন আরো সাতশোর বেশী বিমানসেনা। রয়্যাল এয়ারফোর্সের হামলায় তাদের প্রায় দুই হাজার বিমান বিধ্বস্ত হয়েছিল। তবে বিভিন্ন জনপদের ওপর নির্বিচারে বোমাবর্ষনের ফলে দুই পক্ষ মিলিয়ে এই যুদ্ধে নিহত বেসামরিক নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। আর আহত হয়েছিলেন আরো বিশ হাজারের বেশী মানুষ। 
 
অবশেষে ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জার্মানী এবং ইতালির এই সামরিক জোটে হাত মেলায় এশিয়ার পরাশক্তি জাপান। এই ত্রিদেশীয় জোটকে অক্ষশক্তি নাম দিয়েছেন ইতিহাসবিদরা। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো একই সামরিক জোটে থাকলেও জার্মানী এবং ইতালী সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। একদিকে ইতালী ইউরোপজুড়ে আধিপত্য বিস্তারের পরিবর্তে নিজেদের উপনিবেশের সংখ্যা বৃদ্ধির ওপর গুরূত্ব দিচ্ছিল। যার ধারাবাহিকতায় ইতালীর সেনাবাহিনী আলবেনিয়া, গ্রিস, মিশর এবং ইথিওপিয়া দখলে অভিযান শুরু করে। কিন্তু এই অভিযানগুলোয় খুব একটা সাফল্যের দেখা পায়নি তারা। বরং বলকান অঞ্চলে গ্রীক এবং বৃটিশ যৌথ প্রতিরোধের মুখে ইতালি পিছু হটতে বাধ্য হয়। মিশরেও একই পরিনতির শিকার হয় ইতালীয় সেনাবাহিনী। জোটের মিত্র দেশকে সামরিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য উত্তর আফ্রিকা এবং বলকান অঞ্চলে সেনা মোতায়েন করতে বাধ্য হয় জার্মানী। এতে পুরো বলকান অঞ্চল অক্ষশক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
 
১৯৪১ সালে জার্মান স্বৈরশাসক অ্যাডল্ফ হিটলার তার সেনাবাহিনীর জন্য নতুন একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন দখলের সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে অপারেশন বার্বারোসা নামক একটি অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহন করে। অপারেশন বার্বারোসার মুল উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ স্থলভাগ দখল এবং সেখানে জার্মান বংশোদ্ভূতদের স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করা। এই লক্ষ্যে জার্মান সেনাবাহিনী ১৯৪১ সালের ২২শে জুন সোভিয়েত ইউনিয়ন দখলে অভিযান শুরু করে। জেনে অবাক হবেন, ঐ দিনটির ঠিক ১২৯ বছর আগে ১৮১২ সালের ২৪শে জুন ইউরোপের আরেক সেনাপতি রাশিয়া দখলের চেষ্টা করেছিলেন। অনেকেই হয়তো বুঝে ফেলেছেন, এখানে ফরাসী সেনাপতি নেপোলিয়ন বোনাপার্টের কথা বলা হচ্ছে। ঐ অভিযানে নেপোলিয়নের সাথে থাকা প্রায় ৯ লাখ সেনার মধ্যে সাড়ে ছয় লাখের মত নিহত হয়েছিল। বলাই বাহুল্য, রাশিয়া দখলের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারেননি নেপোলিয়ন। উল্টো এই অভিযানের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না পারাই পরবর্তীতে এই ফরাসী সেনাপতির পতনের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১২৯ বছর পর একই ভুল করা অ্যাডল্ফ হিটলারকেও সেই একই পরিনতির মুখোমুখি হতে হয়।
 
এদিকে, বিশ্বযুদ্ধের প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপানের আধিপত্য খর্ব করার জন্য দেশটির ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে জাপানের সামরিক বাহিনীর জন্য অপরিহার্য জ্বালানী তেল এবং ইস্পাত আমদানী বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি মোকাবেলায় মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং সিঙাপুরের মত ইউরোপীয় উপনিবেশগুলো দখলের পরিকল্পনা করে জাপান। এই লক্ষ্য অর্জনে একমাত্র বাধা ছিল হাওয়াই দ্বীপের পার্ল হার্বারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী নৌ বহর। প্যাসিফিক ফ্লিট শীর্ষক এই নৌ বহর ধ্বংসে ১৯৪১ সালের ৭ই ডিসেম্বর ঐ বন্দর লক্ষ্য করে হামলা চালায় জাপানের বিমানবাহিনী। এর বদলা নিতে বৃটেন এবং ফ্রান্সের সাথে মিত্রবাহিনীতে যোগ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তবে ক্ষতিগ্রস্থ নৌ বহর মেরামত করে যুদ্ধে সেনা প্রেরণের জন্য বাড়তি সময় প্রয়োজন ছিল তাদের। সেই সময়ে মিয়ানমার এবং সিঙাপুরসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ দখল করে নেয় জাপান।
 
পরের বছর আটলান্টিক মহাসাগরে বৃটেনের যাত্রী এবং পণ্যবাহী জাহাজগুলো লক্ষ্য করে সাবমেরিন হামলা শুরু করে জার্মান নৌবাহিনী। এই হামলায় তাদের ব্যবহৃত ইউ বোটগুলো রীতিমত কিংবদন্তীর পর্যায়ে পৌছে গেছে। ১৯৪২ সালের এপ্রিল মাস থেকে শুরু হওয়া এই নৌযুদ্ধটি ব্যাটল অভ আটলান্টিক নামে পরিচিত। এই মাসেই যুক্তরাষ্ট্র গোপনে একটি মহাশক্তিশালী সমরাস্ত্র নির্মানে গবেষণা শুরু করে। ম্যানহাটন প্রজেক্ট শীর্ষক এই গবেষণা প্রকল্পেই প্রথম পারমানবিক অস্ত্র আবিষ্কার করা হয়েছিল। এই বছর জুন মাসের পর থেকে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যাওয়া শুরু করে। ১৯৪২ এর সেপ্টেম্বর মাসে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপপুঞ্জগুলো জাপানের দখলমুক্ত করার লক্ষ্যে সম্মিলিত সামরিক অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। এই বছর আফ্রিকা মহাদেশেও অক্ষবাহিনী উপুর্যপুরি পরাজয়ের শিকার হয়। মিত্রবাহিনীর প্রতিহামলায় মিশর দখলের চেষ্টায় ইতি টানতে বাধ্য হয় তারা। উত্তর পশ্চিমে মিত্রবাহিনীর হামলায় মরক্কো এবং আলজেরিয়াসহ ফরাসী উপনিবেশগুলো অক্ষশক্তির দখল মুক্ত হয়। এই মহাদেশে জার্মানীর শেষ ঘাটি ছিল তিউনিশিয়ায়। ১৯৪৩ সালের মে মাস নাগাদ সেখানেও তারা আত্মসমর্পনে বাধ্য হয়।
 
১৯৪৩ সালের জুলাই মাস থেকে পুরো ইউরোপ নাতসীবাহিনীর দখলমুক্ত করার লক্ষ্যে ত্রিমূখী আক্রমন শুরু করে মিত্রবাহিনী। পূব দিক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের রেড আর্মি ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে। দক্ষিণে আফ্রিকা থেকে মিত্রবাহিনী ইতালির নিয়ন্ত্রণে থাকা সিসিলি দ্বীপপুঞ্জে অবতরণ করে। আর পশ্চিমে ফ্রান্সের কোন উপকূলে বিপুল পরিমান সেনা প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর জন্য ফ্রান্সের কোন উপকূল ব্যবহার করা হবে তা নিয়ে মতানৈক্যের কারণে এর বাস্তবায়ন প্রায় এক বছর পিছিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৪ সালের জুন মাসে নরম্যান্ডি উপকূলে প্রায় ২১ লাখ সেনা অবতরণ করে। অপারেশন ওভারলর্ড শীর্ষক এই অভিযানটি ইতিহাসের বৃহত্তম সেনা অভিযান হিসেবে বিবেচিত হয়। এতে অংশ নেয়া সেনাদের অধিকাংশই ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন এবং ক্যানাডার নাগরিক।      
 
মিত্রবাহিনীর ত্রিমূখী হামলায় পিছু হটতে হটতে নাতসীবাহিনী ১৯৪৫ সালের জানুয়ারী মাসে জার্মানীর ভেতর ঢুকে যেতে বাধ্য হয়। এই বছর ফেব্রুয়ারী মাসে বর্তমান ইউক্রেইনের ইয়ালটা শহরে মিত্রবাহিনীর সরকারপ্রধানদের মধ্যে এক ঐতিহাসিক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যেখানে একত্রিত হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট, বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সরবাধিনায়ক জোসেফ স্টালিন। এই সম্মেলনেই লীগ অভ নেশন্স ভেঙে দিয়ে নতুন একটি বিশ্ব সংস্থা গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতিসংঘ তাদের কার্যক্রম শুরু করে। এসময় মিত্রবাহিনীর জার্মানী অভিমুখে যাত্রাও বন্ধ ছিল না। এপ্রিল মাস নাগাদ কোধ বার্লিন শহরটিও সোভিয়েত সেনারা ঘিরে ফেলেছিল। মে মাসে জার্মানীর চূড়ান্ত আত্মসমর্পনের দু দিন আগে আত্মহত্যা করেন অ্যাডল্ফ হিটলার। 
 
১৯৪৫ সালের জুন মাস থেকে জাপানের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করে মিত্রবাহিনী। জুলাই মাসে দেশটির সরকারকে নিশর্ত আত্মসমর্পনের আল্টিমেটাম দেয়া হয়। এই আল্টিমেটাম প্রত্যাখান করায় আগস্ট মাসে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি শহরে দুটি পারমানবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় যুক্তরাষ্ট্র। এই বিস্ফোরণে জনবহুল শহর দুটির প্রায় আড়াই লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। বিধ্বংসী এই হামলার পর দিশেহারা হয়ে পড়ে জাপান। একদিকে ছিলো ফের পারমাণবিক হামলার আশংকা, অন্যদিকে ছিলো মিত্রবাহিনী যে কোনো সময় দেশটিতে ঢুকে পড়তে পারে। এমন অবস্থায় ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট নিশর্ত আত্মসমর্পনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় জাপান। এরপর ২রা সেপ্টেম্বর আত্মসমর্পনপত্রে স্বাক্ষর করে দেশটি। এর মধ্য দিয়েই আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্তি ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের।
 
২য় বিশ্বযুদ্ধ যে শুধু বিপুলসংখ্যক প্রাণহানি আর ধ্বংসযজ্ঞের স্বাক্ষি হয়েছে তাই না, এই যুদ্ধ গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবনে আমুল পরিবর্তনের সূচনা করেছিলো। ভবিষ্যত বিপর্যয় সামাল দেয়ার জন্য যেমন জাতিসংঘের সৃষ্টি হয়েছিলো তেমনি জন্ম নিয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্র বা সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো সুপার পাওয়ারেরও। আর এই দুই সুপার পাওয়ারের মধ্যে প্রায় অর্ধশতক ধরে চলা স্নায়ুযুদ্ধ তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আরেক রোমাঞ্চকর ইতিহাস। 

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!