ডার্ক ওয়েব
ইন্টারনেটের রহস্যময় অন্ধকার জগৎ
ইন্টারনেট সেবাটির কারণে গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে মানুষের যোগাযোগব্যবস্থায় এক অভিনব অধ্যায়ের সূচনা হয়। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে নিমেষের মধ্যে যোগাযোগ করা সম্ভব। কিন্তু এই যোগাযোগে উত্স এবং গন্তব্য সম্পর্কে সব তথ্য সংযুক্ত থাকায়, আগ্রহী ব্যক্তির পক্ষে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর পরিচয় উদঘাটন করা খুবই সহজ কাজে পরিনত হয়। বিশেষ করে রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে সংবেদনশীল এবং গোপনীয় তথ্য আদান প্রদানের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এই সংকট মোকাবেলায় মার্কিন নৌবাহিনীর গবেষণা সংস্থা ন্যাভাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিকে নতুন এক ধরনের নেটওয়ার্ক তৈরীর দায়িত্ব দেয়া হয়। সংক্ষেপে এনআরএল নামে পরিচিত এই সংস্থাটি অনিয়ন রাওটিং শীর্ষক একটি নেটওয়ার্ক আবিষ্কার করে। এই নেটওয়ার্কে যোগাযোগের সময় মাঝপথে উত্স বা গন্তব্য সম্পর্কে কোন তথ্য জানা সম্ভব হয় না। এর কারণ এই নেটওয়ার্কে যোগাযোগের জন্য ইন্টারনেটের মত সরাসরি সংযোগের বদলে একটি ওভারলে নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা হয়। ওভারলে নেটওয়ার্কে মূলত দুই পক্ষের যোগাযোগে সাধারণ ইন্টারনেটের ভৌত সংযোগের ওপর একটি ভার্চুয়াল বা পরাবাস্তব সংযোগ স্থাপন করা হয়। আমরা ইন্টারনেটে যে ওয়েবসাইটগুলো দেখতে পাই তা সারফেস ওয়েব নামে পরিচিত। এর বিপরীতে এই অনিয়ন রাওটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে ওয়েবসাইটগুলো ভিজিট করতে হয় তার নাম রাখা হয়েছে ডার্ক নেট বা ডার্ক ওয়েব। এই ডার্ক নেটের ওয়েবসাইটগুলো ভিজিট করতে চাইলে আপনার হয় বিশেষ কোন সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হবে অথবা ওয়েব সাইটটির অ্যাডমিন পর্যায়ের অনুমোদন প্রয়োজন পড়বে।
এতক্ষনের বর্ণনা আপনার কাছে বেশী জটিল মনে হলে, সহজ কথায়
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের একটি সামরিক গবেষণা কেন্দ্র বিশেষ এক ধরণের নেটওয়ার্ক
উদ্ভাবন করে যেখানে ব্যবহারকারীর পরিচয় এবং ভৌগলিক অবস্থান সম্পূর্ণ অজ্ঞাত থাকবে।
এবং সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স অ্যাজেন্সি বা সিআইএ’র মত সরকারী বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার
কাজের সুবিধার্থেই এই প্রযুক্তির উদ্ভাবন করা হয়েছিল। কিন্তু অচিরেই এর উদ্ভাবকরা
বুঝতে পেরেছিলেন, অনিয়ন রাওটিং প্রযুক্তিটি জনসাধারনকেও ব্যবহারের সুযোগ না দিলে,
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সদস্যদের জন্য এটি তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলবে। এই
উদ্ভাবকদের একজন রজার ডিঙ্গেলডাইন। যিনি ২০০৪ সালে অনুষ্ঠিত এক নিরাপত্তা সম্মেলনে
তাদের সেই উপলব্ধি সম্পর্কে বলেন, প্রযুক্তিটির ব্যবহার শুধু গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর
মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকলে এই নেটওয়ার্ক থেকে কেউ জনসাধারণের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা
করলেই সবাই বলবে, যোগাযোগকারী নির্ঘাত সিআইএ’র এজেন্ট। এই পরিস্থিতি এড়াতেই
যুক্তরাষ্ট্র সরকার অনিয়ন রাওটিং প্রযুক্তিটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে
দিয়েছিল। ওপেন সোর্স লাইসেন্সের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া এই প্রযুক্তিটি টোর নামে
পরিচিত। দি অনিয়ন রাওটার শব্দগুলোর আদ্যাক্ষর ব্যবহার করে এই নামটি তৈরী হয়েছে। এই
টোর সফটওয়্যারটি ডাউনলোড করে আপনি বিশ্বজুড়ে অনিয়ন রাওটিং প্রযুক্তি ব্যবহারকারী
ওয়েব সাইটগুলো ভিজিট করতে পারবেন। ডার্ক নেটের জন্য এই টোরের পর বর্তমানে একাধিক
নেটওয়ার্ক তৈরী করা হয়েছে।
আগেই জানিয়েছি একত্রে এই নেটওয়ার্কগুলো ডার্ক ওয়েব নামে
পরিচিত। ইন্টারনেট বিশেষজ্ঞদের বর্ণনা অনুযায়ী একটি ওয়েব সাইটকে হয় সারফেস ওয়েব
অথবা ডিপ ওয়েব হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এই দুই ধরণের ওয়েব সাইটের মধ্যে একমাত্র
তফাতটি হলো সারফেস ওয়েবের সাইটগুলো গুগলের মত বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিনের পক্ষে
তালিকাভূক্ত এবং প্রদর্শন করা সম্ভব হয়। এর বিপরীতে ডিপ ওয়েবের কন্টেন্টগুলো কোন
সার্চ ইঞ্জিনের পক্ষে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় না। অর্থাত বিভিন্ন আর্থিক
প্রতিষ্ঠানের অনলাইন লেনদেনের ওয়েব সাইট থেকে শুরু করে নেটফ্লিক্স, এবং আপনার
জিমেইল বা হটমেইলের ইনবক্সটিও ডিপ ওয়েবেরই অংশ। ধারণা করা হয় এই ডিপ ওয়েবে থাকা
কন্টেন্টের পরিমান সারফেস ওয়েবের তুলনায় অনেক বেশী। কিন্তু কোন সার্চ ইঞ্জিনের
পক্ষে এই কন্টেন্টগুলোর তালিকা করা সম্ভব না হওয়ায় এই পরিমান নির্ণয় করা প্রায়
অসাধ্যই বলতে হবে। বিশ বছর আগে ২০০১ সালে চালানো এক গবেষণাপত্রে অণুমান করা হয়
সারফেস ওয়েবের তুলনায় ডিপ ওয়েবে কমপক্ষে পাচশো গুণ বেশী কন্টেন্ট রয়েছে। সর্বোপরি
এই ডিপ ওয়েবের অন্তর্ভূক্ত যে সাইটগুলো ভিজিট করতে আপনার বিশেষ কোন সফটওয়্যার বা
অ্যাডমিন পর্যায়ের অনুমোদনের প্রয়োজন পড়বে সেগুলোকে ডার্ক ওয়েব হিসেবে আখ্যায়িত
করা হয়েছে।
এবারে চলুন এই ডার্ক ওয়েবের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেটওয়ার্ক দি অনিয়ন
রাওটার বা টোর ব্যবহার করে আপনি কী কী সেবা পেতে পারেন তা সম্পর্কে ধারণা নেয়া
যাক। আগেই জানিয়েছি এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে আপনি ইমেইল যোগাযোগ থেকে শুরু করে
ব্রাওজিং এর মত আপনার দৈনন্দিন প্রয়োজনগুলো মেটাতে পারবেন। কিন্তু এর জন্য আপনি যে
লিংকগুলোয় ক্লিক করবেন তার শেষে আমাদের পরিচিত ডট কম, ডট নেট বা ডট ও আর জি’র বদলে
ডট অনিয়ন শব্দটি লেখা থাকবে। গুগল ক্রোম বা মোজিলা ফায়ারফক্সের মত সাধারণ ব্রাওজার
ব্যবহার করে ডট অনিয়ন লিংকগুলো ভিজিট করা সম্ভব হবে না। এর জন্য আপনাকে টোর
ব্রাওজারের মত বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হবে। সেখানে পর্দার এই লিংকটি টাইপ
করলে আপনি ডার্ক ওয়েবের একটি সাইটে প্রবেশ করতে সক্ষম হবেন। এই সাইটটির নাম হিডেন
উইকি। এখানে ডার্ক নেট ব্যবহারকারী বিভিন্ন সেবার একটি তালিকা পাওয়া যায়। জেনে
অবাক হবেন, তুমুল জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকেরও ডার্ক ওয়েবে
ব্যবহারযোগ্য একটি লিংক রয়েছে। এছাড়া ডাক ডাক গো নামক একটি সার্চ ইঞ্জিনও ডার্ক
ওয়েবে বেশ জনপ্রিয়।
সমস্যা হলো, নাম পরিচয় গোপন রাখতে আগ্রহী সাধারণ মানুষ এবং
সরকারী গোয়েন্দাদের পাশাপাশি অপরাধ জগতের সদস্যদের কাছেও এই টোর নেটওয়ার্ক বেশ
জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাটপাড় এবং জালিয়াত থেকে শুরু করে ভাড়াটে খুনীদের মত জঘন্য
মানুষরাও তাদের সম্ভাব্য মক্কেলদের সাথে সংযোগ স্থাপনে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।
যেমন ধরুন এই ডার্ক ওয়েব ব্যবহার করে ২০১১ সাল থেকে নিম্নমানের ওষুধ অনলাইনে
অবৈধভাবে বাজারজাত শুরু করে সিল্ক রোড শীর্ষক একটি ওয়েবসাইট। ২০১৩ সালে এফবিআইয়ের
অভিযানে বন্ধ হবার আগে এই অবৈধ ব্যবসায় উপার্জন হয়েছিল দশ হাজার কোটি টাকার বেশী।
এফবিআইয়ের এই অভিযান ডার্ক ওয়েব সম্পর্কে জনসাধারণকে আরো বেশী কৌতূহলী করে তোলে।
ফলে এর জনপ্রিয়তা কমার বদলে উল্টো বেড়ে গিয়েছিল। এর কয়েক মাসের মাথায় ডার্ক ওয়েবে
সিল্ক রোড টু পয়েন্ট জিরো নামে নতুন একটি ওয়েব সাইটের আবির্ভাব ঘটে। ২০১৪ সালে
ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকো থেকে এই ওয়েব সাইটের প্রতিষ্ঠাতাকে আটক করে এফবিআই।
সে দফায় মাত্র কয়েক ঘন্টা পরেই ডার্ক ওয়েবে সিল্ক রোড থ্রি পয়েন্ট জিরো উন্মুক্ত
হয়েছিল।
আরো উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে, অবৈধ ওষুধের ব্যবসা ডার্ক ওয়েবে
চলমান অসংখ্য অবৈধ ব্যবসার একটি অংশ কেবল। এছাড়া আরো যে ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ডের
জন্য এই ডার্ক ওয়েব ব্যবহার করা হয় তার বর্ণনা শুনলে আপনি শিউরে উঠতে বাধ্য হবেন।
এর মধ্যেই প্রথমেই রয়েছে রেড রুম নামে পরিচিত এক ধরণের ওয়েব সাইট। এই সাইটগুলোয়
ইচ্ছুক এবং অনিচ্ছুক মানুষদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালানোর ভিডিও অর্থের বিনিময়ে
দেখা যায়। হাত-পা, মুখ-চোখ বাধা অসহায় মানুষগুলোকে কেটে ছিড়ে রক্তাক্ত করার সেই
ভিডিওগুলো দেখে পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করে বিকৃত মানসিকতার দর্শকরা। এছাড়া যৌন
কর্মকান্ডের নামে শিশুদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের ভিডিও দেখারও একাধিক ওয়েব সাইট
রয়েছে এই ডার্ক ওয়েবে। এফবিআই প্রায়ই অভিযান চালিয়ে এ ধরনের অবৈধ কর্মকান্ড ভেস্তে
দেয়। সম্প্রতি তারা ললিটা সিটি এবং প্লেপেন শীর্ষক এমন দুটি ওয়েব সাইটের কার্যক্রম
বন্ধ করে দিয়েছে।
২০১৬ সালে ডার্ক ওয়েবের দু হাজার সাতশো তেইশটি সাইটের ওপর একটি জরীপ চালানো হয়। তাতে দেখা যায় এর মধ্যে এক হাজার পাঁচশো সাতচল্লিশটিতেই বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ড চলছে। অর্থাত অবৈধ ওয়েব সাইটের সংখ্যা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ বা অর্ধেকের বেশী। তবে টোর ব্রাওজার ব্যবহারকারীদের শতকরা মাত্র তিন থেকে ছয় ভাগ এই অবৈধ সাইটগুলো ভিজিট করছেন। অর্থাত শতকরা ৯৫ ভাগের বেশী টোর ব্রাওজার ব্যবহারকারী স্রেফ নিজের নাম পরিচয় গোপন রাখতেই এটি ব্যবহার করছেন।