বিশ্বে স্থলভাগ দিয়ে ঘেরা বৃহত্তম জলাশয়টির নাম কাস্পিয়ান। কিন্তু এটি সাগর না হ্রদ তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এটিকে সাগর দাবী করার কারণ এর পানি লবনাক্ত। যদিও সাগরের পানির স্বাভাবিক লবনাক্ততার তুলনায় তা তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র। আবার এটিকে হ্রদ দাবী করার কারণ এর সাথে কোন সাগর বা মহাসাগরের সংযোগ নেই।
কাস্পিয়ান সাগর
কাস্পিয়ান নামক জলাশয়টির অবস্থান ইউরোপ এবং এশিয়া মহাদেশের ঠিক
মধ্যিখানে। এর পশ্চিম দিকে রয়েছে ককেশাস পর্বতমালা। আর পূবে মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ
তৃণভূমি। এই জলাশয়টির মোট আয়তন তিন লাখ একাত্তর হাজার বর্গ কিলোমিটার বা এক লাখ
তেতাল্লিশ হাজার বর্গ মাইলের বেশী। রাজনৈতিক সীমানার বিচারে জলাশয়টি বর্তমানে মোট
পাঁচটি সার্বভৌম দেশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই দেশগুলো হচ্ছে কাজাখস্তান, রাশিয়া,
আজারবাইজান, ইরান এবং তুর্কমেনিস্তান। অবশ্য গত শতকের শেষ দশক পর্যন্তও
ক্যাস্পিয়ান জলাশয়টি রাজনৈতিকভাবে কেবল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ইরান এই দুই দেশের
নিয়ন্ত্রণে ছিল।
ব্ল্যাক সি বা কৃষ্ণ সাগরের মত এই কাস্পিয়ান সাগরেরও সৃষ্টি হয়েছিল
জুরাসিক আমলে ইউরেশিয়ার বিশাল এলাকা জুড়ে বিদ্যমান প্যারাটেথিস মহাসাগর শুকিয়ে
যাওয়ার ফলে। বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী আনুমানিক ৫৫ লাখ বছর আগে এই জলাশয়টি
পুরোপুরি আলাদা হয়ে যায়। এরপর সূর্যের তাপে পানি বাষ্পীভূত হবার ফলে জলাশয়টির
লবনাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়া শুরু হয়। তবে কয়েক লাখ বছর পর উত্তর প্রান্ত থেকে
একাধিক নদ-নদীর পানি জলাশয়ে আসা শুরু করায় ধীরে ধীরে লবনাক্ততা আবার কমতে
থাকে। বর্তমানে কাস্পিয়ান সাগরের লবনাক্ততা শতকরা এক দশমিক দুই ভাগ। যার অর্থ এই
জলাশয়ের এক লিটার পানি শুকিয়ে ফেললে ১২ গ্রামের মত লবন পাওয়া যাবে। সাধারণত সাগর
এবং মহাসাগরের পানির লবনাক্ততা শতকরা সাড়ে তিন ভাগের বেশী হয়।
সব মিলিয়ে মোট একশো ত্রিশটি জলধারা কাস্পিয়ান সাগরে পানি সরবরাহ
করে। তবে এর মধ্যে চারটি নদী এই জলাশয়ের সিংহভাগ পানি সরবরাহ করছে। এগুলো
হচ্ছে ভলগা, উরাল, কুরা এবং তেরেক। এর মধ্যে ভলগা নদী এই জলাশয়ের মূল পানি
সরবরাহকারী। এর বিপরীতে ক্যাস্পিয়ান সাগর এন্ডোরেয়িক ঘরানার জলাশয়। যার অর্থ
সূর্যের তাপে বাষ্পীভূত হওয়া ছাড়া এই জলাশয় থেকে পানি বের হবার কোন পথ নেই।
উত্তর দক্ষিণে এই জলাশয়টির সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য এক হাজার ত্রিশ কিলোমিটার
বা প্রায় সাড়ে ছয়শো মাইল। আর পূব-পশ্চিমে জলাশয়টি সর্বোচ্চ চারশো পয়ত্রিশ
কিলোমিটার বা দুশো সত্তুর মাইল চওড়া। ক্যাস্পিয়ান সাগরের গড় গভীরতা দুশো এগারো
মিটার বা প্রায় সাতশো ফুট। তবে এর সর্বোচ্চ গভীরতা এক হাজার পঁচিশ মিটার বা তিন
হাজার তিনশো ষাট ফুট। সব মিলিয়ে এই জলাশয়ে বিদ্যমান পানির পরিমান আটাত্তুর হাজার
ঘণ কিলোমিটারের বেশী, বা প্রায় উনিশ হাজার ঘণ মাইল।
ভৌগলিকভাবে এই জলাশয়টি তিনভাগে বিভক্ত। নর্দার্ন কাস্পিয়ান নামক এর
উত্তরাঞ্চলের গড় গভীরতা মোটে ৫ থেকে ৬ মিটার বা ১৬ থেকে বিশ ফুটের মত। মধ্য
কাস্পিয়ান এলাকায় এই গভীরতা বৃদ্ধি পেয়ে গড়ে ১৯০ মিটার বা ছয়শো বিশ ফুটে দাঁড়ায়।
আর সবচেয়ে গভীর দক্ষিণ কাস্পিয়ান জলাশয়টির তলদেশের গড় গভীরতা এক হাজার মিটার বা
তিন হাজার তিনশো ফুটের বেশী। গড় গভীরতায় এমন বিশাল তারতম্যের ফলে কাস্পিয়ান
সাগরে থাকা মোট জলের শতকরা মাত্র এক ভাগ উত্তর কাস্পিয়ান অবস্থিত। মধ্য
কাস্পিয়ান রয়েছে শতকরা তেত্রিশ ভাগ আর দক্ষিণ কাস্পিয়ান শতকরা ছেষট্টি ভাগ
জল।
অন্য যে কোন সাগরের মত এই কাস্পিয়ানের বুকেও একাধিক দ্বীপ
বিদ্যমান। তবে এই জলাশয়ের সবগুলো দ্বীপই উপকূলের কাছাকাছি অবস্থিত। অপেক্ষাকৃত
গভীর এলাকায় কোন দ্বীপ নেই বললেই চলে। এই দ্বীপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়টির নাম
ওগুরিয়া অ্যাডা। এর আয়তন সাইত্রিশ বর্গ কিলোমিটার। এই দ্বীপে মানব বসতি থাকলেও
কাস্পিয়ান সাগরের অধিকাংশ দ্বীপই জনশূণ্য। একাধিক পরিযায়ী প্রজাতির পাখি এমন
কয়েকটি দ্বীপকে নিজেদের সাময়িক বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করে। এই সাগরের উপকূলে
গুরূত্বপূর্ণ একাধিক জনপদ অবস্থিত। এর মধ্যে আজারবাইজানের রাজধানী বাকু, ইরানের
আস্তারাবাদ এবং রাশিয়ার দাগেস্তান নামক শহরগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মানুষ এবং পরিযায়ী পাখির বাইরে এই ক্যাস্পিয়ান এলাকায় বসতি স্থাপনকারী
আরেকটি প্রাণী হচ্ছে সীল। কাস্পিয়ান সীল নামক এই প্রাণীগুলো শুধু এই জলাশয়ের
তীরেই পাওয়া যায়। একশো বছর আগেও এই এলাকায় প্রায় দশ লাখের মত সীল বসবাস করতো।
মানুষের নির্বিচার শিকারের ফলে এই সংখ্যাটা এখন এক লাখেরও নীচে নেমে এসেছে। এছাড়া
ব্যাঙের পোনার মত দেখতে ট্যাডপোল গোবিজ নামক এক ধরণের মাছও শুধু এই কাস্পিয়ান
সাগরেই পাওয়া যায়। প্রত্মতাত্তিকদের গবেষণা অনুযায়ী এই জলাশয়ে এক সময় কয়েক
প্রজাতির তিমি এবং ডলফিন গোত্রের জলচর স্তণ্যপায়ী প্রাণী বসবাস করতো। কিন্তু কালের
পরিক্রমায় এই প্রাণীগুলো পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জলচর বিভিন্ন প্রাণীর
পাশাপাশি এই কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী এলাকা বিলুপ্তপ্রায় একাধিক স্থলচর
প্রাণীর জন্যও সুপরিচিত। এই প্রাণীগুলোর মধ্যে ক্যাস্পিয়ান বাঘ, এশিয়াটিক সিংহ,
এশিয়াটিক চিতা এবং পারশিয়ান চিতাবাঘ অন্যতম।
কাস্পিয়ান সাগর এখান থেকে আহরিত ক্যাভিয়ারের জন্য বিশ্বখ্যাত। এই
ক্যাভিয়ার মূলত স্টার্জন নামক বিশেষ এক গোত্রভূক্ত মাছের ডিম। তবে বিশ্বের কিছু
দেশে স্যামন মাছের ডিমও ক্যাভিয়ার হিসেবে খাওয়া হয়। স্টার্জন ক্যাভিয়ার কালো রঙের
হলেও স্যামন ক্যাভিয়ারের রঙ কমলা রঙের হয়ে থাকে। সাধারণত রুটি বা বিস্কুটের ওপর
এটি জেলির মত মাখিয়ে খাওয়া হয়। বিশ্বের সবচেয়ে দামী ক্যাভিয়ার বেলুগা স্টার্জন
নামের এক প্রজাতির মাছের পেট থেকে সংগ্রহ করা হয়। এই বেলুগা স্টার্জন প্রজাতির মাছ
কেবল কাস্পিয়ান সাগরেই পাওয়া যায়। এক কেজি বেলুগা স্টার্জন ক্যাভিয়ার কিনতে
আপনার খরচ হবে প্রায় বিশ লাখ টাকা।
ক্যাভিয়ারের পাশাপাশি এই কাস্পিয়ান সাগর ও তার উপকূলবর্তী এলাকা
জ্বালানী তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের মত বিভিন্ন খণিজ সম্পদে বেশ সমৃদ্ধ। এই
কাস্পিয়ান সাগরের শুধু ইরানের নিয়ন্ত্রণে থাকা অংশেই বিদ্যমান অপরিশোধিত
জ্বালানী তেলের পরিমান প্রায় দেড়শো বিলিয়ন ব্যারেল। যা থেকে দেশটি দৈনিক গড়ে চার
মিলিয়ন ব্যারেলের মত অপরিশোধিত জ্বালানী তেল আহরন করছে। এছাড়াও সাগরের এই অংশে
রয়েছে প্রায় এক হাজার ট্রিলিয়ন ঘণফুট প্রাকৃতিক গ্যাস। যা পুরো পৃথিবীর মোট মজুদের
শতকরা ১৬ ভাগ। এছাড়া রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন অংশেও বিপুল পরিমান জ্বালানী তেল ও
প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ রয়েছে। জেনে অবাক হবেন বিশ্বের প্রথম অফ শোর প্ল্যান্ট
স্থাপন করা হয় এই কাস্পিয়ান সাগরের বুকেই। ১৮৭৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাকু শহরের
উপকূলে এই প্ল্যান্টটি স্থাপন করেছিল। বর্তমানে এটি অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে
সৃষ্টি হওয়া আজারবাইজানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
কাস্পিয়ান সাগর ও তার উপকূলবর্তী এলাকায় এমন একাধিক তেল ও গ্যাস
উত্তোলন প্রকল্প চালু থাকায় স্থানীয় পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্থ
হচ্ছে। এসব প্রকল্পের আওতাধীন কারখানার বর্জ্য এই সাগরে ফেলায় পানি দূষনে অনেক
প্রজাতির মাছ এবং জলচর প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ঝুকির মুখে থাকা এই প্রজাতিগুলো
সংরক্ষণে অবশ্য একাধিক সংস্থা চেষ্টা করছে। তবে আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং আঞ্চলিক
সহযোগিতার অভাবে এসব সংরক্ষণ চেষ্টার কর্মকাণ্ডে খুব একটা গতির সঞ্চার সম্ভব হচ্ছে
না।
ইতিহাস অনুযায়ী কাস্পিয়ান সাগরের জলপৃষ্ঠের উচ্চতা নিয়মিত ওঠানামা
করে থাকে। ১৯২৯ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে এর জলপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় তিন মিটার বা দশ
ফুট কমে গিয়েছিল। এরপর ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে তা আবার তিন মিটার বা দশ ফুট
বৃদ্ধি পায়। বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী কাস্পিয়ান সাগরের এই প্রবণতা জলাশয়টির
সৃষ্টিলগ্ন থেকেই ছিল। এর জলপৃষ্ঠের উচ্চতা মূলত ভলগা নদীর সরবরাহকৃত পানির
সমানুপাতে বৃদ্ধি পায়। তবে বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী এই স্বাভাবিক ওঠানামার
বাইরে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে কাস্পিয়ানের জলপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর গড়ে ছয়
সেন্টিমিটারের বেশী বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজারবাইজান জাতীয় বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের
বিজ্ঞানীরা ২০১৯ সালে এই গবেষণা চালান।
আগেই জানিয়েছি বর্তমানে এই কাস্পিয়ান জলাশয়ের তীরে মোট পাঁচটি দেশ
অবস্থিত। কিন্তু গত শতকের পঞ্চাশের দশকে যখন জলাশয়টির সীমানা বন্টন করা হয়েছিল তখন
এটি স্রেফ ইরান এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন এই দুটো দেশের নিয়ন্ত্রণে ছিল। পরবর্তীতে
সোভিয়েত ইউনিয়ন নামক রুশ সাম্রাজ্য ভেঙে ঐ এলাকায় নতুন তিনটি দেশের সৃষ্টি হয়। ফলে
প্রাক্তন সোভিয়েত অংশটুকু রাশিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানের
মধেই খণ্ডিত হয়ে যায়। এই কারণে এই জলাশয়টির বৃহত্তম অংশ ইরানের নিয়ন্ত্রণে
রয়েছে।
কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী পাঁচটি দেশের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে
সম্প্রীতি বজায় থাকলেও সবগুলো দেশের নৌবাহিনীই এই জলাশয়ে নিয়মিত টহল দেয়। তবে এ
ক্ষেত্রেও রাশিয়া এবং ইরানের নৌবাহিনীর আকার বাকি দেশগুলোর কয়েক গুন হওয়ায় এখনো এই
জলাশয়টির ব্যাপারে ইরান এবং রাশিয়াই মোড়লের মত আচরন অব্যাহত রেখেছে।
ইরান এবং রাশিয়া কাস্পিয়ান এলাকায় নিজেদের মোড়লসদৃশ ভূমিকা পরিহার
না করলে, এই এলাকার প্রকৃতি, জনসম্পদ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ দিন দিন আরো কঠিন
হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে আশার ব্যাপার হলো, এই লক্ষ্যে এরিমধ্যে দেশ
পাঁচটি একটি সংগঠন তৈরী করেছে। এছাড়া প্রতি দুই বছর পরপর কাস্পিয়ান সামিট নামক
একটি শীর্ষ সম্মেলনে মিলিত হচ্ছেন পাঁচটি দেশের সরকারপ্রধানরা। এই ধারা অব্যাহত
থাকলে ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর গঠনমূলক সমাধানে পৌছুনো সম্ভব হবে
বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।