কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
মানবজাতির সবশেষ আবিষ্কার?
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, নিসন্দেহে মানুষের শ্রেষ্ঠতম আবিষ্কার। কিন্তু এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়টা কী? কয় ধরণের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই বা সৃষ্টি করা সম্ভব? চূড়ান্ত পর্যায়ের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উদ্ভাবিত হলে তার পরিনতি কী হতে পারে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর, খোদ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়টির মতই রহস্যময় এবং জটিল।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে জানতে হলে সবার আগে আমাদের স্রেফ
বুদ্ধিমত্তা বিষয়টি সম্পর্কে জানতে হবে। বুদ্ধিমত্তার সংগা কি হতে পারে? যেমন ধরুন
মানুষকে বলা হয় জীবজগতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। বিবর্তনের ধারায় আমাদের
ঘণিষ্ঠতম জীবিত প্রাণী হচ্ছে শিম্পাঞ্জি। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এই শিম্পাঞ্জির
সাথে আমাদের ডিএনএ কাঠামো’র শতকরা প্রায় ৯৬ ভাগ হুবহু একইরকম। অর্থাত বলতে পারেন
আমরা সবাই আসলে শতকরা ৯৬ ভাগ শিম্পাঞ্জি। কিন্তু অবশিষ্ট চার ভাগের কারণে মানুষ আজ
পৃথিবী ত্যাগ করে মহাশূণ্যে পাড়ি জমাচ্ছে। এমনকি মঙ্গল গ্রহের বুকে বসতি স্থাপনেরও
পরিকল্পনা করছে। অন্যদিকে ঘরের নেংটি ইদুর আর জঙ্গলের গেছো ইদুরের ডিএনএ কাঠামোর
মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগ পার্থক্য থাকলেও এই দুই প্রজাতির প্রাণী কিন্তু লাখ লাখ বছর
যাবত একইভাবে জীবনধারণ করে চলেছে।
সর্বোচ্চ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রাণী এই মানুষের
পর্যবেক্ষণযোগ্য বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডগুলোর মধ্যে একটি হলো দাবা বা পাশার মত
কোন খেলায় অংশগ্রহন। এরকম আরেকটি খেলার নাম গো। খেলার নিয়মটা খুব সাদামাটা। আপনাকে
আপনার প্রতিপক্ষের তুলনায় বেশী এলাকা দখল করতে হবে। প্রাচীন এই খেলাটি মানুষ গত
প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরেই খেলছে। কিন্তু ২০১৬ সালে গুগল নির্মিত কৃত্রিম
বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রোগ্রাম আলফা-গো এই খেলায় ততকালীন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন লি
সিডোলকে ৫টির মধ্যে ৪টিতেই পরাস্ত করে। দাবা অথবা পাশা খেলার মত গো’তে কম্পিউটার
ব্যবহার করে জয়ী হবার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ এই খেলার বোর্ডে একটি গুটির সম্ভাব্য
গতিপথের সংখ্যা লিখতে গেলে আপনাকে একের পর ১৭১টি শূণ্য বসাতে হবে। আর মহাবিশ্বে
বিদ্যমান মোট পরমানুর সংখ্যা লিখতে একের পর মাত্র ৮১টি শূণ্য বসালেই হবে।
এর মাত্র এক বছরের মাথায় আলফা-গো জিরো নামক আরেকটি প্রোগ্রাম
সেই আলফা-গো প্রোগ্রামটিকে এই গো খেলায় হারাতে সক্ষম হয়েছে। দু’টো কম্পিউটার
প্রোগ্রামের মধ্যে অনুষ্ঠিত মোট ১০০টি খেলার ১০০টিতেই আলফা-গো জিরো জয়ী হয়।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এই প্রোগ্রামটি মানুষের সাহায্য ছাড়াই এই খেলাটি শেখে এবং
লাখ লাখ খেলা বিশ্লেষণের মাধ্যমে এটি অভিনব সব কৌশলও আবিষ্কার করেছে। জেনে অবাক
হবেন, পুরনো আলফা-গো প্রোগ্রামটির দক্ষতা অতিক্রম করতে নতুন প্রোগ্রামটির মাত্র ৪০
দিন সময় লেগেছিল। অর্থাত ৪০ দিনেরও কম সময়ে এটি মানুষের আড়াই হাজার বছরে সঞ্চিত জ্ঞান
আহরণ করতে সক্ষম হয়েছিল। কোন অস্তিত্বের জ্ঞানের পরিমান যদি এই হারে বাড়তে থাকে,
তবে ভেবে দেখুন তো আজ থেকে কয়েক শো বছর পর মানুষের অবস্থান কই দাড়াবে? হয়তো
ভাবছেন, মানুষের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলতে পারে এমন কোন বুদ্ধিমত্তা বন্ধ করতে
তো তার পাওয়ারটা অফ করে দিলেই হবে। কিন্তু আজ থেকে দুই বা তিন লাখ বছর আগে যখন
মানুষ নামক একটি নতুন প্রজাতি যখন মাথাচাড়া দিচ্ছিল তখন নিয়ান্ডারথালের মত ঐ সময়ের
শীর্ষ বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজাতিগুলো কিন্তু আমাদের সেই অগ্রযাত্রা রোধ করতে পারেনি।
তাছাড়া কৃত্রিম সেই বৃদ্ধিমত্তা যদি ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত থাকে তবে তো কোন
কথাই নেই। কারণ ইনটারনেটের কোন অফ সুইচ তৈরী করা সম্ভব না।
আমরা যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে চিন্তা করি তখন মহাশক্তিধর
বিভিন্ন অস্তিত্বের কথা ভেবে নেই, যারা শুধু মানুষের কল্যাণেই আসবে না, মুহূর্তের
মধ্যে মানব প্রজাতির অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দেবার সামর্থ্যও তাদের থাকবে।
কিন্তু আসলেই কি তেমন কিছু ঘটার আশংকা রয়েছে? হলিউডের বিভিন্ন
মুভিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিশিষ্ট সত্বাগুলোকে সাধারণত অশুভ উদ্দেশ্যের অধিকারী
রোবট হিসেবেই বেশী দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বর্তমান
চিত্রটা একেবারেই আলাদা।
এখন পর্যন্ত আমরা যে সব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উদ্ভাবন করেছি
সেগুলোকে সংকীর্ণ বা দুর্বল বুদ্ধিমত্তা বলা যায়। সহজ কথায় নির্দিষ্ট একটি কাজ
দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করতে সক্ষম বুদ্ধিমত্তাকে দুর্বল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আখ্যা
দেয়া যেতে পারে। আমাদের চারপাশে কৃত্রিম বুদ্ধিবৃ্ত্তিক সত্বাগুলো এই ধরনের
বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। এবং আলফা-গো এই ধরণের একটি দুর্বল বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন
প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রামগুলো শুধু মানুষের ছবি বা কণ্ঠ শনাক্তেই দক্ষ না, গো এর মত
সহজ নিয়মের খেলা থেকে শুরু করে জটিল নিয়মের ডোটা টু এর মত খেলাতেও পারদর্শী।
২০১৭ সালে এই খেলার বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে ওপেনএআই নামক একটি
প্রোগ্রাম পেশাদার গেইমার ডেন্ডিকে পরপর দুটি খেলায় পরাজিত করে শীর্ষস্থান দখল
করে। আলফা-গো জিরোর মত এই ওপেনএআই প্রোগ্রামটিও মানুষের সাহায্য ছাড়াই খেলাটি
শিখেছে। মানুষের হিসেবে কয়েক লাখ বছর এটি ক্রমাগত নিজের বিরুদ্ধে ওয়ান-টু-ওয়ান এই
খেলাটি খেলেছে। শুরুতে স্রেফ হাটতেও প্রোগ্রামটার হোচট খেতে হতো কিন্তু এক পর্যায়ে
এর দক্ষতা মানুষকে অতিক্রম করে গেছে। আপনি স্পটিফাই ব্যবহার করলে দেখেছেন নিশ্চয়ই
আপনার পছন্দের ওপর নির্ভর করে প্রোগ্রামটি প্রতিদিন আপনার জন্য নতুন গানের তালিকা
তৈরী করতে পারে। আর অ্যামাজন আপনি কি কিনছেন সেই তথ্য ব্যবহার করে আপনাকে কিনতে
পারেন এমন উপকরণের তালিকা সরবরাহ করে। এসবই দুর্বল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কল্যাণে
ঘটছে।
ভাবছেন একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম কিভাবে শিক্ষাগ্রহণ করে? যে
প্রক্রিয়ায় বিষয়টা ঘটে তার নাম মেশিন লার্নিং বা যান্ত্রিক শিক্ষা। এক কথায়
কম্পিউটারকে মানুষের মত চিন্তা করতে শেখানোর প্রক্রিয়াটিকেই মেশিন লার্নিং বলা হয়।
প্রক্রিয়াটা অনেকটাই মানবশিশুর বেড়ে ওঠার সাথে মিলে যায়। জন্মের পর আমরা স্রেফ
একটা পরনির্ভরশীল অস্তিত্ব হিসেবে অবস্থান করি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমরা নতুন
জ্ঞান আহরণ এবং পৃথিবীটাকে চিনে নেয়া শুরু করি। এভাবেই আমরা ধীরে ধীরে
প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষে পরিনত হই। যে পদ্ধতি ব্যবহার করে এই মেশিন লার্নিং সম্পন্ন
করা হয় তাকে নিউরাল নেটওয়ার্ক বলে। পদ্ধতিটা দেখতে মানুষের মস্তিষ্কের মত। আমাদের
মস্তিষ্ক অসংখ্য নিউরনে ঠাসা। এই নিউরনগুলোই আমাদের চিন্তা করার এবং সমস্যা
সমাধানের সক্ষমতা দেয়। তবে একটি নিউরন কিন্তু পুরো ব্যাপারটার জন্য দায়ী না। বলতে
পারেন এককভাবে একেকটি নিউরন একটা সমস্যার ক্ষুদ্র একটা অংশ সমাধান করে কেবল। অনেকটা
গাড়ির অ্যাসেম্বলি লাইনের মত।
বিষয়টা আরো ভালভাবে বুঝতে চলুন একটি নিউরনবিশিষ্ট এমন একটি
নিউরাল নেটওয়ার্কের কথা ভেবে নেই। এর উদ্দেশ্য কোন মানুষ জীবিত আছে কি না তা
নির্ধারণ করা। সেক্ষেত্রে এই নিউরনের কাজটাকে নিম্নোক্ত উপায়ে ভাগ করা যেতে পারে।
এটি প্রথমে পরীক্ষা করবে মানুষটির শ্বাসপ্রশ্বাস চালু আছে কি না। যদি থাকে তবে সে
জীবিত। যদি না থাকে সেক্ষেত্রে নিউরনটি পরীক্ষা করে দেখবে তার নাড়িতে স্পন্দন
পাওয়া যাচ্ছে কি না। যদি পাওয়া যায় তবে সে জীবিত। আর পরপর দুটো পরীক্ষাই ব্যর্থ
হলে নিউরনটি বুঝে নেবে, মানুষটি মৃত।
বুঝতেই পারছেন আমরা যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন
প্রোগ্রামগুলোর কথা বলছি তার কোনটারই নিউরাল নেটওয়ার্ক মাত্র একটি নিউরন বিশিষ্ট
না। বরং কোনটায় কয়েক লাখ এমন নিউরনের অস্তিত্ব রয়েছে। যেগুলো একত্রে বা পরষ্পরের
সাথে সমন্বিতভাবে তাদের কাজ চালিয়ে যায়। এর ফলে মানুষের তুলনায় এই প্রোগ্রামগুলো
অনেক দ্রুত পৃথিবী সম্পর্কে জ্ঞান আহরণে সক্ষম। কারণ প্রোগ্রামগুলোর শক্তিশালী
নিউরাল নেটওয়ার্ক দ্রুতগতিতে বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করতে সক্ষম। শুধু বিশ্লেষণই
না, এই নেটওয়ার্কগুলো সেই তথ্য থেকে শিখতেও পারে।
কিন্তু এই নেটওয়ার্কগুলো এত দ্রুতগতিতে জ্ঞান আহরন করতে পারে
কি কারণে? জীববিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী আমাদের মস্তিষ্কের নিউরনগুলোর গতি
সাধারণত ২০০ হার্জের মত হয়ে থাকে। অর্থাত এগুলো সেকেন্ডে দুশোটি তথ্য বিশ্লেষণ
করতে পারে। এর বিপরীতে আধুনিক ট্রানজিস্টরগুলোর গতি দুই গিগাহার্জ ছাড়িয়ে গেছে।
যার মানে সেগুলো প্রতি সেকেন্ডে দুই হাজার কোটির বেশী তথ্য বিশ্লেষনে সক্ষম।
পাশাপাশি আপনার মস্তিষ্কের নিউরনগুলো পরষ্পরের সাথে অ্যাক্সন
নামক একধরণের কোষ দ্বারা সংযুক্ত। এই কোষের মাধ্যমেই নিউরনগুলো পরষ্পরের মধ্যে
তথ্য আদান-প্রদান করে। কিন্তু অ্যাক্সনের গতি সেকেন্ডে মাত্র ১০০ মিটার। যা শব্দের
গতির তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র। এর বিপরীতে কম্পিউটারের ট্রানজিস্টরগুলো পরষ্পরের
মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করে আলোর গতিতে। যা সেকেন্ডে প্রায় ত্রিশ কোটি মিটার। এর
অর্থ একটা শক্তিশালী কম্পিউটার মাত্র এক সপ্তাহে যে পরিমান জ্ঞান আহরন করতে সক্ষম
সেই পরিমান জ্ঞান অর্জনে একটা মানুষের কমপক্ষে ২০ হাজার বছর লেগে যাবে। তাছাড়া
আপনার মস্তিষ্কের আকার নির্দিষ্ট হওয়ায় সেখানে সম্ভাব্য নিউরনের সংখ্যাটাও সীমিত।
কিন্তু একটা কম্পিউটার প্রোগ্রামের জন্য অসংখ্য নিউরনবিশিষ্ট নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরীর
জন্য আপনার হার্ডডিস্কের স্পেইস বাড়ালেই হচ্ছে। অবশ্য দুর্বল প্রকৃতির কৃত্রিম
বুদ্ধিমত্তার জন্য খুব একটা বেশী স্পেইস লাগে না। ডোটা টু এর চ্যাম্পিয়নশিপে
শিরোপাজয়ী ওপেনএআই প্রোগ্রামটা একটা ইউএসবি ড্রাইভেই কপি করা সম্ভব।
এই দুর্বল বা সংকীর্ণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরবর্তী পর্যায়টির
নাম আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স বা এজিআই। যা একইসময় একাধিক কাজ দক্ষতার
সাথে সম্পন্ন করতে পারে। কাগজে-কলমে এধরণের বুদ্ধিমত্তাগুলো হুবহু মানুষের মতই
চিন্তা করতে সক্ষম। কিন্তু বাস্তবে সেই সক্ষমতা অর্জনে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
ভেবে দেখুন, আপনাকে যখন কোন প্রশ্ন করা হয় তখন সংশ্লিষ্ট কতগুলো বিষয় চিন্তা করে
আপনি তার উত্তর দিচ্ছেন। এসময় আপনার মস্তিষ্ককে আপাতদৃষ্টিতে অসম্পর্কিত একাধিক
বিষয় বিশ্লেষণ করতে হচ্ছে। একটা কম্পিউটারের জন্য এই কাজটা মোটেও সহজ কিছু না।
কারণ মানব মস্তিষ্ক কম্পিউটারের মত আলোর গতিতে তথ্য আদান-প্রদান বা বিশ্লেষণে
সক্ষম না হলেও তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা করার সামর্থ্য রয়েছে। মানুষ কোন সমস্যার
মুখোমুখি হলে সেটাকে পাখির চোখে পর্যবেক্ষণ করে তা অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রতর সমস্যায়
ভাগ করে নিতে পারে। পাশাপাশি মানব মস্তিষ্ক উদ্ভাবনে সক্ষম, সে আবেগ, অনুভূতি এবং
পরোক্ষ অর্থ বুঝতে পারে। মানুষ সমাজ তৈরী করেছে, নতুন নতুন সব খেলার সৃষ্টি করেছে
এবং সে হাসতে পারে। এই কাজগুলো কোন কম্পিউটারকে শেখানো প্রায় অসম্ভবই বলতে হবে।
একটা কম্পিউটারকে আপনি কিভাবে নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে শেখাবেন? কিভাবে তাকে এমন
কিছু ভাবতে শেখাবেন যা এখন পর্যন্ত কেউ কখনো ভাবেনি? এতসব প্রতিবন্ধকতার মুখেও
এজিআই উদ্ভাবন মানুষের জন্য এখন বাধ্যতামূলক বিষয়ে পরিনত হয়েছে। কারণ এই
প্রযুক্তিটি উদ্ভাবনে সক্ষম হলেই আমাদের পক্ষে বর্তমানে অসম্ভব অনেক কিছু করা
সম্ভব হবে।
এই অতিবুদ্ধিসম্পন্ন এজিআইগুলোর বুদ্ধি সম্পর্কে ধারণা পেতে এই
চিত্রটা আপনাকে সাহায্য করবে। ধরুন এটা বিভিন্ন অস্তিত্বের বুদ্ধিমত্তার আপেক্ষিক
চিত্র। একটা পিপড়ার বুদ্ধি একেবারেই তলানিতে। ইদুরকে তার একটু ওপরে রাখতে হবে।
গড়পড়তা বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে এই লাইনটায় রাখা হলে, আইনস্টাইনের মত প্রতিভাবানরা
থাকবেন আরেকটু ওপরে। এবার যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয়, এই চিত্রে সুপার
ইন্টেলিজেন্ট এআই’র অবস্থান কোথায় হবে, আপনি হয়তো হিসেব নিকেশ করে বলবেন সাধারণ
মানুষের ৫ গুণ উচ্চতায়। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা একেবারেই আলাদা। সুপার ইন্টেলিজেন্ট
এআই’র পক্ষে অবিরত জ্ঞান আহরণ সম্ভব হওয়ায় এর বুদ্ধি জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাবে।
এই বুদ্ধির মাত্রা একটা সীমারেখা অতিক্রম করলে আমরা টেকনলোজিকাল সিঙ্গুলারিটি
অর্জনে সক্ষম হবো। এর অর্থ ঐ সময় নতুন নতুন অসংখ্য জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং দর্শনের
আবির্ভাব ঘটবে, যার অনেক কিছুই হয়তো বর্তমান মানুষ বুঝতেও পারবে না। এবং তারপর
অচিরেই সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বুদ্ধি পুরো মানবজাতির সমষ্টিগত বুদ্ধির কয়েকশো
কোটি গুনে গিয়ে দাড়াবে।
একটা বিষয় চিন্তা করে দেখুন, বর্তমানে পৃথিবীতে পিপিলিকার
সংখ্যা আনুমানিক ৫৫ লক্ষ কোটিরও বেশী। অর্থাত প্রতিটি মানুষের বিপরীতে পৃথিবীতে
প্রায় ১০ লাখ পিপড়া জীবন ধারণ করে যাচ্ছে। অথচ, আমরা আমাদের চলার পথে কোন পিপড়া
দেখলে স্বাচ্ছন্দে সেটাকে পিষে মেরে ফেলি। কোন সময় যদি অতিবুদ্ধিসম্পন্ন কৃত্রিম
বুদ্ধিমত্তা এই পরিস্থিতিতে মানুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় আর মানুষের ভূমিকা পিপড়ার
মতই তুচ্ছ হয়ে যায়, তখন পৃথিবীর অবস্থা কি হবে ভেবে দেখুন তো।
অতিবুদ্ধিসম্পন্ন এই সব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাগুলো আমাদের পরিচিত
সফটওয়্যারের মত আচরণ করবে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানে এটি সবচেয়ে
দ্রুতগতির উপায়টিও বেছে নিতে পারে। যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মঙ্গলজনক হয় না। কারণ
মানুষ এবং কম্পিউটারের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য হলো, মানুষের পক্ষে লব্ধ জ্ঞানের
উপযোগিতা বিবেচনা করে ধীরে ধীরে বিচক্ষণ হয়ে ওঠা সম্ভব। এই জ্ঞান এবং বিচক্ষণতার
মধ্যে তফাত হলো, ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সমস্যা সমাধানে দক্ষতা অর্জনকেই জ্ঞান
বলা হয়, কিন্তু বিচক্ষণতা হচ্ছে লব্ধ জ্ঞানটি সর্বোচ্চ মঙ্গলজনক উপায়ে কাজে
লাগানো।
উদাহরণ হিসেবে ধরুন এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে পৃথিবীর খাদ্য
সমস্যা দূর করার দায়িত্ব দেয়া হলো। এখন প্রোগ্রামটা হিসেব কষে দেখতে পারে, এই
সমস্যা দূর করার দ্রুততম উপায় হচ্ছে পৃথিবীর সব মানুষকে হত্যা করা। কারণ মানুষ না
থাকলে ক্ষুধার বিষয়টিও থাকছে না, তাই খাদ্য সমস্যাও দূর হয়েছে। কিন্তু বুঝতেই
পারছেন আমরা অবশ্যই তেমনটা চাই না। অর্থাত এই প্রোগ্রামগুলোর মানুষের মত চিন্তা
করার সামর্থ্য থাকতে হবে। নৈতিক এবং মানবিক মূল্যবোধের বিষয়গুলোও একে শিখতে হবে।
যেন সবসময় তা সমস্যার দ্রুততম সমাধানের পথে না হেটে বরং মানবিক সমাধান বেছে নেয়।
তার মানে আমরা আসলে অতিবুদ্ধিমান একটি অর্ধমানব সাইবর্গ সৃ্ষ্টির চেষ্টা করে
যাচ্ছি।
একটু খেয়াল করে দেখেছেন কি, সময়ের সাথে সাথে আমরা কতটা
সাইবর্গের মত হয়ে গেছি। আমাদের অধিকাংশ চাহিদাগুলোই এখন আর জৈবিক না, বরং
প্রযুক্তিগত। এই যেমন স্মার্টফোনের মত ডিভাইসগুলো কিন্তু এরিমধ্যে আপনার অংশে
পরিনত হয়েছে। আপনার মনে যে প্রশ্নই জাগুক, আপনার মুঠোফোনটা মুহূর্তেই তার উত্তর
জানাতে সক্ষম। এখন এই কাজটায় বেশী সময় লাগছে কারণ আপনার ইনপুট দেবার গতি অনেক ধীর।
এখন ভেবে দেখুন আপনার মস্তিষ্কের নিউরনগুলো যদি সরাসরি ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত
থাকতো তবে কত দ্রুত আপনি এই উত্তরগুলো পেয়ে যেতেন।
নিউরাললিংক নামক একটি প্রতিষ্ঠান এই লক্ষ্যে বেশ কিছুদূর
এগিয়েও গেছে। আপনার মস্তিষ্ক মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত। লিম্বিক সিস্টেম এবং
কর্টেক্স। লিম্বিক সিস্টেম আপনার প্রবৃত্তি এবং জান্তব অনুভূতিগুলোর জন্য দায়ী। আর
কর্টেক্স ব্যবহার করে আপনি বিভিন্ন সমস্যার সমাধান এবং উচ্চতর চিন্তা করেন।
নিউরাললিংক এর সাথে তৃতীয় একটি স্তর সংযোজন করতে চাইছে যা হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর
এবং ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত। অর্থাত আমাদের স্মৃতিশক্তি এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতা
দুটোই কয়েকশো গুণ বেড়ে যাবে। এর ধারাবাহিকতায় হয়তো একটা সময় মানুষের মনে হবে এই
পরাবাস্তব জগতটাই দৈনন্দিন একঘেয়ে জীবনের তুলনায় অনেক বেশী উপভোগ্য। তখন হয়তো
জৈবিক এই দেহ ত্যাগ করে আমরা পুরোপুরি পরাবাস্তব সেই জগতের বাসিন্দায় পরিনত হবো।
তবে সেই সময়টা এখনো সুদূর পরাহতই আছে। দু একশো বছরের মধ্যে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির
কোন আশংকা বা সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করা হচ্ছে।
কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা মানব জাতির জন্য কল্যানকর বা ক্ষতিকর যেটাই হোক না কেন, বিজ্ঞানীরা কিন্তু এর উন্নয়নে বলত গেলে আদা জল খেয়ে লেগেছেন। বলা যায় না খুব শিঘ্রী হয়তো অধিকতর ক্ষমতাসম্প্পন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিচয় ঘটতে চলেছে আমাদের। অনেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বেশ আশাবাদী, আবার অনেকেই আশংকা করছেন এটিই হয়তো মানব জাতির সবশেষ যুগান্তকারী আবিষ্কার হতে চলেছে। তবে, আদপে কি ঘটবে তা কবেল সময়ই বলতে পারে।