প্রথম বিশ্বযুদ্ধ | ইতিহাসের বিভীষিকাময় অধ্যায়

0
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিলো ১৯১৪ সালের ২৮শে জুলাই। ১৯১৮ সালের ১১ই নভেম্বর পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে অন্তত আড়াই কোটি মানুষ প্রাণ হারায়।


প্রথম বিশ্বযুদ্ধ


মানুষে মানুষে যুদ্ধ এবং রক্তপাতের ইতিহাস মানব সভ্যতার মতই পুরনো। স্থলভাগের পরিমান বৃদ্ধি থেকে শুরু করে খনিজ সম্পদ আহরণ এবং স্বাধীনতা অর্জনের মত বহুবিধ কারণে একাধিক গোত্র, জাতি, রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্য পরষ্পরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধ নামক বিভীষিকাময় এই ঘটনাটি বহুল প্রচলিত হলেও নানা কারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন যুদ্ধ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। এই ভিডিওতে আপনাদের এমন এক ঐতিহাসিক যুদ্ধের কথা জানাবো। বিংশ শতকের প্রথম ভাগে সংঘটিত এই যুদ্ধে একাধিক জাতি বা সাম্রাজ্য নয় শুধু, গোটা বিশ্বই জড়িয়ে পড়েছিল। আর এই যুদ্ধে যে পরিমান প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল তা আগের কয়েক হাজার বছরের সবগুলো যুদ্ধ মিলিয়েও ঘটেনি। নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে। সবমিলিয়ে বিভিন্ন পক্ষে সাত কোটির বেশী মানুষ এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯১৪ সালের ২৮শে জুলাই থেকে শুরু হয়ে ১৯১৮ সালের ১১ই নভেম্বর পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে প্রায় দেড় কোটি বেসামরিক নাগরিকসহ অন্তত আড়াই কোটি মানুষ প্রাণ হারায়।



প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কেন শুরু হয়েছিলো?

 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ বুঝতে হলে আমাদের ঐ যুদ্ধ শুরুর প্রায় সত্তুর বছর আগে ফিরে যেতে হবে। ঐ সময় বিশ্ব মানচিত্র এমন শতাধিক জাতিরাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল না। বরং বিশ্বের অধিকাংশ স্থলভাগই ইউরোপ বা এশিয়ার কোন পরাশক্তির দখলে ছিল। এই পরাশক্তিগুলোর মধ্যে ইউরোপে বৃটিশ, ফরাসী এবং অস্ট্রো-হাঙেরিয়ান সাম্রাজ্য উল্লেখযোগ্য। আর এশিয়ার পরাশক্তিগুলোর মধ্যে জাপানী, রুশ এবং অটোমান সাম্রাজ্য অন্যতম ছিল। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ ইউরোপ এবং এশিয়াজুড়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার উত্থান ঘটতে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় ততকালীন অস্ট্রো-হাঙেরিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ কিংডম অব সার্ডিনিয়া ১৮৪৮ সালে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। এর সাত বছর পর ফ্রান্সের সামরিক সহায়তায় সার্ডিনিয়ার সেনাবাহিনী অস্ট্রো-হাঙেরিয়ার দখলদার বাহিনীকে পরাজিত করে। সার্ডিনিয়ার এই উদাহরণে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রতিবেশী কয়েকটি রাজ্যও অস্ট্রো-হাঙেরিয়ার ঔপনিবেশিক প্রভূদের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে কিংডম অব ইতালি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই দুই পক্ষের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধটি ইতালির স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হয়। সাম্রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তে এই অস্থিরতার সুযোগে উত্তরে অবস্থিত প্রুশিয়া রাজ্যের সেনাবাহিনীও অস্ট্রো-হাঙেরিয়ার সীমান্তে ঢুকে পড়ে। ১৮৬৭ সালে শক্তিশালী অস্ট্রো-হাঙেরিয়ান সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে ঐ সাম্রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে নর্থ জার্মান ফেডারেশন নামক একটি রাষ্ট্র সাম্রাজ্য গড়ে তোলে প্রুশিয়া। পাচ বছর পর এই ফেডারেশন প্রতিবেশী ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে থাকা দক্ষিনের জার্মান রাজ্যগুলোও দখল করে নেয়। ১৮৭১ সালে ফরাসী শহর ভার্সেই রাজপ্রাসাদে এক আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে ঐ রাজ্যগুলোর নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করে ফ্রান্স। এভাবে জার্মানী নামক একটি রাজ্যের যাত্রা শুরু হয়। একীভূত জার্মানী হিসেবে আত্মপ্রকাশের পরেই রাজ্যটি নিজেদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বিবিধ কার্যক্রম শুরু করে। আর ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলে শক্তি বৃদ্ধির জন্য ততকালীন রুশ এবং অস্ট্রো-হাঙেরিয়ান সাম্রাজ্যের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে জার্মানী। 
 
উনবিংশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধে ইউরোপের মত এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলেও প্রচন্ড রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছিল। ১৮৭৭ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণাধীন বলকান অঞ্চলে জনসাধারণের মাধে শাসকগোষ্ঠীর প্রতি তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। এই সুযোগে অটোমান সাম্রাজ্যের চিরশত্রু হিসেবে পরিচিত রাশিয়া বলকান অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া জাতীয়তাবাদী চেতনাকে আরো উষ্কে দিয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় অটোমান সাম্রাজ্যের ঐ অংশ ভেঙে মন্টেনিগ্রো, সার্বিয়া, বুলগেরিয়া এবং রোমানিয়া নামক নতুন চারটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। বলকান অঞ্চলে রুশ হস্তক্ষেপের বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি জার্মানি এবং অস্ট্রো-হাঙেরিয়ার মত  ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলো। ভবিষ্যতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে ১৮৮০ সালে এই দুই সাম্রাজ্য একটি সামরিক জোট গঠন করে। এসময় উত্তর আফ্রিকার তিউনিশিয়ায় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার জন্য ফ্রান্স এবং ইতালির মধ্যে কূটনৈতিক লড়াই শুরু হয়। ইতালির প্রতিবাদ উপেক্ষা করেই তিউনিশিয়ায় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে ফ্রান্স। এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে ফ্রান্সের চিরশত্রু জার্মানী এবং অস্ট্রো-হাঙেরিয়া সাম্রাজ্যের সাথে হাত মেলায় ইতালি। এর ফলে দ্বিপাক্ষিক সামরিক জোটটি ত্রিপাক্ষিক জোটে পরিনত হয়। 
 
ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর এবার বিশ্বের অন্যান্য মহাদেশের দিকে চোখ ফেরায় জার্মানী। আফ্রিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার আন্তর্জাতিক অনুমোদন পেতে ১৮৮৪ সালে বার্লিনে এক শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করে জার্মান সরকার। বার্লিন কনফারেন্স নামে পরিচিত ঐ সম্মেলনে বৃটেন এবং ফ্রান্সের মত ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছিলেন। সম্মেলনে নতুন উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু শর্ত আরোপ করা হয়। কিন্তু সেই শর্তগুলো না মেনেই আফ্রকার পশ্চিম উপকূল এবং এশিয়ার কয়েকটি অঞ্চল নিজেদের দখলে নিয়ে সেখানে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে জার্মানী। প্রতিবেশী রাজ্যের এমন আগ্রাসী আচরণে আতংকিত হয়ে ১৮৯২ সালে নিজেদের মধ্যে একটি গোপন সামরিক চুক্তি করে জার্মানীর পূব এবং পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ফ্রান্স ও রাশিয়া। এরপর ১৯০২ সালে ইতালির সাথে আরেকটি গোপন চুক্তি করে ফ্রান্স। ঐ চুক্তি অনুযায়ী পরষ্পরের সাথে যুদ্ধে না জড়াতে একমত হয়েছিল রাজ্য দুটি। অন্যদিকে, অটোমান সাম্রাজ্যের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরালো করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে জার্মানী। এই লক্ষ্যে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর মধ্যে ১৯০৫ সালে বার্লিন থেকে অটোমান সাম্রাজ্যের বাগদাদ শহর পর্যন্ত একটি রেললাইন নির্মান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই রেললাইনের ফলে খনিজ তেলসমৃদ্ধ মেসোপোটেমিয়া অঞ্চলের সাথে জার্মানীর সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এই অঞ্চলের খনিজ তেলের প্রতি বৃটিশ সাম্রাজ্যও লোভী চোখে তাকিয়ে ছিল। ফলে জার্মানীর সাথে অটোমান সাম্রাজ্যের সম্পর্ক এত ঘণিষ্ঠ হয়ে ওঠায় বৃটেনেরও টনক নড়ে ওঠে। একই সময় নিজেদের নৌবাহিনীর শক্তিও বহুগুনে বৃদ্ধি করে জার্মানী। ফলে বিশ্বের সমুদ্রপথগুলোয় বৃটেনের রয়্যাল নৌবাহিনীর একচ্ছত্র আধিপত্য ক্ষুন্ন হবার আশংকা তৈরী হয়েছিল। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ১৯০৭ সালে ফ্রান্স এবং রাশিয়ার মধ্যে বিদ্যমান গোপন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে বৃটেন। এই তিন পরাশক্তির মধ্যে গঠিত জোটটি ট্রিপল অনটন্ট নামে পরিচিত। এভাবে বিংশ শতকের শুরুতে পুরো ইউরোপ দুটো মহাজোটে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একদিকে জার্মানী, অস্ট্রো-হাঙেরিয়া এবং ইতালির সমন্বয়ে গঠিত ট্রিপল অ্যালায়েন্স আর অপর দিকে বৃটেন, ফ্রান্স এবং রাশিয়ার সমন্বয়ে গঠিত ট্রিপল অনটন্ট।
 
বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকটির শুরু থেকেই বলকান অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে পরষ্পরবিরোধী দুই মহাজোটের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে তৈরী হওয়া রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সার্বিয়া বলকান অঞ্চলে ইউগোস্লাভিয়া নামে একটি স্লাভিক জাতিরাষ্ট্র গঠনে কাজ শুরু করে। সার্বিয়া স্বাধীন হলেও এই জাতিরাষ্ট্রের অন্যতম অংশ বসনিয়া এবং হার্জেগোভেনার মত এলাকাগুলো অস্ট্রো-হাঙেরিয়ান সাম্রাজ্যের দখলে ছিল। অস্ট্রো-হাঙেরিয়ান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে এই দ্বন্দ্বে সার্বিয়ার পেছনে অন্যতম উষ্কানিদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় রাশিয়া। এই দ্বন্দ্বের জেরে অস্ট্রো-হাঙেরিয়ান যুবরাজ ফ্রাসোয়াঁ ফার্দিনান্দকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে সার্বিয়ার এক সশস্ত্র বিপ্লবী। ১৯১৪ সালের জুন মাসের ২৮ তারিখ চালানো ঐ হামলায় ফার্দিনান্দের স্ত্রীও প্রাণ হারান। এর বদলা নিতে জুলাই মাসের ২৮ তারিখ বলকান অঞ্চলে সেনা অভিযান শুরু করে অস্ট্রো-হাঙেরিয়া। 
 
ইতিহাসবিদরা এই দিনটিকেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। বলকান অঞ্চলে অস্ট্রো-হাঙেরির এই হামলায় সমর্থন জানায় ততদিনে বিশ্বের বৃহত্তম পরাশক্তিতে পরিনত হওয়া জার্মানী। অপরদিকে সার্বিয়ার পেছনে দাঁড়ায় প্রতিবেশী রাশিয়া। অস্ট্রো-হাঙেরিয়ান সেনাবাহিনীর মোকাবেলায় পশ্চিম সীমান্তে বাড়তি সেনা মোতায়েন শুরু করে তারা। এর জবাবে শ্লিফেন প্ল্যান শীর্ষক নিজেদের পূর্ব নির্ধারিত সমর পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু করে জার্মান সেনাবাহিনী। এই পরিকল্পনার আওতায় আগস্ট মাসের ১ তারিখ রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে জার্মানী। তবে পুব সীমান্তে সেনা মোতায়েনের পরিবর্তে পশ্চিম দিকে লুক্সেমবার্গ দখল করে নেয় দেশটির সেনাবাহিনী। এমন বিচিত্র সমর পরিকল্পনার কারণ, রাশিয়া এবং ফ্রান্সের মধ্যে গোপন সামরিক চুক্তি সম্পর্কে অবগত ছিল বার্লিন। জার্মান সেনাবাহিনীর জানা ছিল, রাশিয়ার সাথে যুদ্ধের ঘোষণায় ফ্রান্সের সাথেও যুদ্ধে জড়ানোর সমূহ আশংকা রয়েছে। এবং দেশের পূব এবং পশ্চিম সীমান্তে একই সাথে দুটো যুদ্ধে অংশ নিতে হলে জার্মানীর নাস্তানাবুদ হবার সম্ভাবনা অনেক বেশী ছিল। রাশিয়া তাদের পশ্চিম সীমান্তে সেনা মোতায়েন সম্পূর্ণ করার আগেই তাই নিজেদের পশ্চিম দিকে সম্ভাব্য সব হুমকি নির্মূল করাই ছিল জার্মানীর এই সমর পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য। 
 
এই শ্লিফেন পরিকল্পনা অনুযায়ী নিরপেক্ষ বেলজিয়ামের ওপর দিয়ে ফ্রান্সে পৌছানোর কথা ছিল জার্মান সেনাবাহিনীর। কিন্তু দোসরা আগস্ট নিজ দেশের ওপর দিয়ে জার্মান সেনাবাহিনীকে যেতে দেয়া হবে না বলে জানায় বেলজিয়াম সরকার। নিরপেক্ষ দেশ হওয়ায় এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে বলে জানায় তারা। এর জবাবে পরদিন বেলজিয়ামও দখল করে নেয় জার্মান সেনাবাহিনী। একইদিন আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তারা। এর পরদিন বৃটেনও আনুষ্ঠানিকভাবে এই যুদ্ধে প্রবেশ করে। নিরপেক্ষ বেলজিয়ামের মিত্র হিসেবে তারা আগস্টের চার তারিখ জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তি জাপান ঐ সময় বৃটেনের মিত্র ছিল। তাই তারাও জার্মানীর বিরুদ্ধে এ মাসে যুদ্ধ ঘোষণা করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রথম মাসে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল জার্মান এবং অস্ট্রো-হাঙেরিয়ান সীমান্তে রুশ সেনাবাহিনীর অতর্কিত হামলা। উত্তরে জার্মান সীমান্তে এই হামলা খুব একটা কার্যকরী না হলেও দক্ষিনে অস্টো-হাঙেরিয়ান সেনাবাহিনী এই হামলার মুখে পিছু হটা শুরু করে। পুব সীমান্তের মত পশ্চিমেও জার্মান সেনাবাহিনী যুদ্ধের প্রথম দিকে বেশ সাফল্যের দেখা পায়। তাদের উপুর্যপুরি হামলার মুখে সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে ফ্রান্স ও বৃটেনের সম্মিলিত বাহিনী ফরাসী সীমান্ত থেকে পিছু হটে মার্ন এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তোলে। একই সময় ফরাসী রিজার্ভ বাহিনীর মরিয়া হামলায় জার্মান সেনাবাহিনীর প্যারিস অভিমুখে অগ্রযাত্রা থেমে যায়। এরপর জার্মান এবং মিত্র উভয় বাহিনীর সদস্যরাই বেলজিয়ামের উপকূলীয় শহরগুলো দখলে অভিযান শুরু করে। যুদ্ধের এই পর্যায়ে দুই বাহিনীর মধ্যে একটি স্থিতাবস্থার সৃষ্টি হয়। অক্টোবর মাস নাগাদ উত্তরে নর্থ সি থেকে দক্ষিনে নিরপেক্ষ সুইজারল্যান্ডের সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় সাতশো কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পরিখা খনন করে অবস্থান নেয় উভয় পক্ষ। 
 
এ মাসেই সেনাবাহিনীর পাশাপাশি পরষ্পরের বিরুদ্ধে নিজেদের নৌ এবং বিমানবাহিনীও ব্যবহার শুরু করে বৃটেন এবং জার্মানী। বৃটিশ রয়্যাল নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজগুলো জার্মানীর উপকূলজুড়ে অবরোধ গড়ে তোলে। এর জবাবে জার্মানী তাদের ডুবোজাহাজ ব্যবহার শুরু করে। বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে মানুষের নাগালে উন্নতমানের উড়োজাহাজ প্রযুক্তি ছিল না। ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে স্রেফ শত্রুপক্ষের গতিবিধি পর্যবেক্ষনের জন্যই উড়োজাহাজ ব্যবহার করা হতো। তবে অচিরেই এই বিমানের চালকরা পর্যবেক্ষনের পাশাপাশি শত্রু শিবিরের ওপর বোমা বর্ষনের কাজও শুরু করেন। জার্মানী অবশ্য এই কাজে এয়ারশিপ হিসেবে পরিচিত জ্যাপলিনও ব্যবহার করতো। জার্মান এয়ারশিপগুলো ফ্রান্সে দুবার এবং ইংল্যান্ডের বিভিন্ন জনপদের ওপর কমপক্ষে অর্ধশতাধিক হামলা চালিয়েছিল। 
 
১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসের শুরুতে অটোমান সাম্রাজ্য এই যুদ্ধে প্রবেশ করে। চিরপ্রতিদ্বন্দী রাশিয়ার সেনাবাহিনী অস্ট্রো-হাঙেরি এবং জার্মানীর বিরুদ্ধে ব্যস্ত থাকায়, রুশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয় অটোমানরা। ককেশাস অঞ্চলে অবস্থিত রুশ-অটোমান সীমান্ত এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এই সুযোগে পারস্য উপসাগরের তীরে বিশাল এক সেনাবাহিনী পাঠায় বৃটেন। এই বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষের অধিবাসী। এর জবাবে অটোমান বাহিনী মিশরে অবস্থিত বৃটিশ নিয়ন্ত্রনাধীন সুয়েজ খালটি দখলে সেনা অভিযান শুরু করে। উত্তরে ককেশাস অঞ্চলের মত দক্ষিণে সিনাই উপদ্বীপেও অটোমানদের সেনা অভিযান ব্যর্থ হয়। উত্তরে এই ব্যর্থতার জন্য আর্মেনিয়ার অমুসলিম জনসাধারণের রাশিয়ার সাথে আঁতাতকেই মূল কারণ হিসেবে নির্দিষ্ট করে অটোমান শাসকরা। এর বদলা নিতে আর্মেনিয়াজুড়ে গণহত্যা চালায় তারা। ১৯১৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে চালানো এই বর্বর গণহত্যায় আর্মেনিয়ার প্রায় অর্ধেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। 
 
ঐ বছর মে মাসে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে জার্মান ডুবোজাহাজের হামলায় বৃটিশ যাত্রীবাহী জাহাজ লুসিতানিয়া ডুবে যায়। এতে এক হাজার দুইশোর বেশী বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারায়। নিহতদের মধ্যে ১২৮ জন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানায়। বিশ্বজুড়ে চলমান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ডুবোজাহাজ ব্যবহার সাময়িকভাবে কমিয়ে আনে জার্মানী। ১৯৫ সালের জুলাই মাসে ইতালি তার ভোল পাল্টে ট্রিপল অনটন্ট মহাজোটে যোগ দেয়। এরপর তারা তাদের সাবেক মিত্র অস্ট্রো-হাঙেরির সীমান্ত লক্ষ্য করে সেনা অভিযান শুরু করে। ইতালীর মত বলকান দেশ বুলগেরিয়াও এ সময় তাদের জোট পরিবর্তন করে। তবে ট্রিপল অনটন্ট ত্যাগ করে তারা জার্মান মহাজোটে যোগ দিয়েছিল। পক্ষ পরিবর্তনের পর সার্বিয়া দখলে সেনা অভিযান শুরু করে বুলগেরিয়া। এর ধারাবাহিকতায় ততদিন পর্যন্ত এই যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকা গ্রীসের উপকূলে সেনা প্রেরণ করে বৃটিশ ও ফরাসী মিত্রবাহিনী। অর্থাত ১৯১৫ সালের শেষ নাগাদ সুইজারল্যান্ডই ছিল একমাত্র নিরপেক্ষ দেশ যেখানে এই যুদ্ধের কোন সংঘাত অনুষ্ঠিত হয়নি।     
 
পরের বছর ফেব্রুয়ারি মাসে নিজেদের পশ্চিম সীমান্তে হামলা জোরদার করে জার্মান সেনাবাহিনী। এসময় ফরাসী শহর ভার্দুন দখলে তাদের সেনা অভিযানটি ব্যাটল অব ভার্দুন হিসেবে ইতিহাসের পাতায় বিখ্যাত হয়ে আছে। ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখ থেকে শুরু হওয়া সেই অভিযান ডিসেম্বর মাসের আঠারো তারিখ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এই ব্যাটল অব ভার্দুন ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত। এতে মিত্রবাহিনীর অন্তত ৫০ ডিভিশন সেনার বিরুদ্ধে জার্মান বাহিনীর প্রায় ৭৫ ডিভিশন সেনাসদস্য অংশ নিয়েছিল। সব মিলিয়ে তিনশো দুই দিন স্থায়ী সেই সংঘাতে ফরাসী পক্ষে প্রায় তিন লাখ আশি হাজার সেনা প্রাণ হারায়। আর জার্মান বাহিনীর নিহতের সংখ্যা ছিল প্রায় তিন লাখ চল্লিশ হাজার। সব মিলিয়ে এই সংঘাতে উভয় পক্ষের প্রায় সোয়া সাত লাখ সেনা নিহত হয়েছিল। অর্থাত সংঘাতের প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার প্রানহানির ঘটনা ঘটেছে। 
 
এশিয়া মহাদেশের মধ্যপ্রাচ্য এলাকায় বৃটিশ ও ফরাসী যৌথবাহিনী অটোমান এবং জার্মান সেনাবাহিনীর সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছিল। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ১৯১৬ সালের মে মাসে অটোমান সাম্রাজ্যের দখলে থাকা মধ্যপ্রাচ্য নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়ার মর্মে একটি গোপন চুক্তি করে বৃটেন এবং ফ্রান্স। সাইক্স-পিকট এগ্রিমেন্ট নামে পরিচিত এই চুক্তিটিকে মধ্যপ্রাচ্যে বিদ্যমান অস্থিরতার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয়। বিতর্কিত এই চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে অটোমানদের বিরুদ্ধে আরব জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলোকে উষ্কে দেয় বৃটেন। এই ইন্ধনের ফলে বর্তমান সৌদি আরবের মক্কা শহর থেকে অটোমানদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার দাবীতে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে আরবরা। একই মাসে নর্থ সি সাগরে জার্মান এবং বৃটিশ নৌবাহিনীর মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম নৌযুদ্ধটি সংঘটিত হয়। ব্যাটল অব জাটল্যান্ড নামে পরিচিত সেই যুদ্ধে রয়্যাল নৌবাহিনীর মোট ১৫১টি যুদ্ধজাহাজ অংশগ্রহন করে। ৭৮টি ডেস্ট্রয়ার, ২৮টি ব্যাটলশিপ এবং ২৬টি লাইট ক্রুজার ছাড়াও ছিল ৯টি ব্যাটল ক্রুজার এবং ৮টি আর্মার্ড ক্রুজার। অন্যদিকে এই যুদ্ধে অংশ নেয়া ৯৯টি জার্মান নৌযানের মধ্যে ছিল ১৬টি ব্যাটলশিপ, ১১টি লাইট ক্রুজার, ৫টি ব্যাটল ক্রুজার এবং ৬১টি টর্পেডো বোট। ১৯১৬ সালের ৩০শে মে থেকে শুরু হয়ে পয়লা জুন পর্যন্ত তিন দিন ধরে চলা সেই সংঘাতে বৃটিশ নৌবাহিনীর মোট ১৪টি জাহাজ ডুবে গিয়েছিল। আর প্রানহানির সংখ্যা ছিল ছয় হাজারের বেশী। এর বিপরীতে জার্মান নৌবাহিনীর ডুবে যাওয়া জাহাজের সংখ্যা ছিল ১১টি। আর আড়াই হাজারের বেশী জার্মান নৌসেনা এই সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। ১৯১৬ সালের জুলাই মাসে জার্মান এবং মিত্রবাহিনীর মধ্যে আরেকটি রক্তক্ষয়ী সংঘাতের ঘটনা ঘটে। ব্যাটল অব দি সম নামে পরিচিত এই সংঘাতটি ঐ বছর জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে নভেম্বরের ১৮ তারিখ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। এই যুদ্ধে একেক পক্ষে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখের মত সেনাসদস্য অংশ নিয়েছিল। এই যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথমবারের মত ট্যাংক ব্যবহার করে বৃটিশ সেনাবাহিনী। 
 
এক বছরের বেশী সময় ধরে বহাল থাকা বৃটিশ নৌ অবরোধের কারণে ১৯১৬ সালের শীতকালে পুরো জার্মান সাম্রাজ্য জুড়ে তীব্র দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। প্রায় দুই বছর বিশ্বজুড়ে যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় উভয় পক্ষের অর্থনৈতিক অবস্থাই শোচনয়ী হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ফ্রান্স এবং বৃটেনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকায় এই দেশগুলোয় অর্থনৈতিক টানাপোড়েন তেমন তীব্র হয়ে ওঠেনি। পরিস্থিতি পরিবর্তনে আটলান্টিক মহাসাগরজুড়ে পুনরায় নিজেদের ডুবোজাহাজ হামলা শুরু করে জার্মান নৌবাহিনী। শুধু তাই না, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী মেক্সিকোর সরকার প্রধান বরাবর ১৯১৭ সালের জানুয়ারি মাসে একটি টেলিগ্রাম পাঠায় জার্মান সরকার। জিমারম্যান টেলিগ্রাম নামে পরিচিত সেই বার্তায় মেক্সিকোর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিন সীমান্তে সেনা অভিযান শুরুর আহ্বান জানানো হয়েছিল। জার্মানীর জন্য দুর্ভাগ্যজনকভাবে টেলিগ্রামটি গন্তব্যস্থলে পৌছানোর আগেই বৃটিশ গোয়েন্দারা তা আটকে দিতে সক্ষম হন। মেক্সিকোর পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সামনে টেলিগ্রামটি উপস্থাপন করা হয়। এই উষ্কানীর বদলা নিতে ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে জার্মান জোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। 
 
এদিকে, ঐ বছর মার্চ মাসে রাশিয়ায় ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লব শুরু হয়েছিল। রাশিয়ায় প্রচলিত জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সেটা ফেব্রুয়ারি মাস হওয়ায় এই বিপ্লবটি ফেব্রুয়ারি রেভ্যুলিউশন নামেই বেশী পরিচিত। ঐ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় জারতন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে যায়। নতুন সরকার প্রথমে জার্মানীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত রাখলেও, হানাদার বাহিনীর উন্নততর রণকৌশলের মুখে অচিরেই পিছু হটা শুরু করে রুশ সেনাবাহিনী। ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে জার্মানীর কাছে আত্মসমর্পনে বাধ্য হয় রাশিয়া। এই আত্মসমর্পন এবং সমসাময়িক বলশেভিক বিপ্লবের জেরে বিশ্বযুদ্ধের বদলে গৃহযুদ্ধ সামলাতেই ব্যস্ত হয়ে যায় তারা। পূব দিকের হুমকি নির্মূলের পর ১৯১৮ সালের বসন্ত নাগাদ পশ্চিম দিকে পুরো শক্তি নিয়োগ করে জার্মানী। কিন্তু ততদিনে এই যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর পক্ষে প্রায় পঞ্চাশ লাখ মার্কিন সেনা যোগ দিয়েছিলেন। তরতাজা এই বাহিনীর উপুর্যপুরি হামলার মুখে আফ্রকা, এশিয়া এবং ইউরোপের সব অংশেই পিছু হটতে বাধ্য হয় কয়েক বছরের যুদ্ধে বিপর্যস্ত জার্মান সেনাবাহিনী। একই সময় এই জোটের আরেক সদস্য অস্ট্রো-হাঙেরি এবং অটোমান সাম্রাজ্যও অভ্যন্তরীন জাতীয়তাবাদী বিপ্লব এবং বহিরাগত মিত্রবাহিনীর দ্বিমুখী হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় ১৯১৮ সালের অক্টোবর মাসে অটোমান সাম্রাজ্য এবং নভেম্বর মাসে অস্টো-হাঙেরি মিত্রবাহিনীর কাছে নিশর্ত আত্মসমর্পন করে। একই সময় জার্মানীতে গনবিপ্লবের মুখে সিংহাসন ত্যাগে বাধ্য হন কাইজার উপাধিধারী জার্মান সম্রাট। এর বদলে জার্মান সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় আসা নতুন গণতান্ত্রিক সরকার মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯১৮ সালের ১১ই নভেম্বর ফ্রান্সের ভার্সেই শহরে আত্মসমর্পন পত্রে স্বাক্ষর করে জার্মানী। এই চুক্তিটি ট্রিটি অব ভার্সেই নামে পরিচিত। এর মধ্য দিয়ে চার বছরের বেশী সময় ধরে চলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে।

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!