সুন্দর ভয়ংকর সুন্দরবন | সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন

0
বাংলাদেশের খুলনা বিভাগ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা এই দুটো জেলা মিলিয়ে বিস্তৃত বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, সুন্দরবন


সুন্দরবন


এখন থেকে এক লাখ বছর আগেও দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পুর্ব এশিয়ার পুরোটা জুড়ে ছিল গহীন জঙ্গল। আনুমানিক সত্তুর থেকে আশি হাজার বছর আগে এই এলাকায় প্রথম আদিমানুষের বসবাস শুরু হলে ধীরে ধীরে সেই জঙ্গলের আয়তন সংকুচিত হতে থাকে। তার আগ পর্যন্ত বিশ্বের বৃহত্তম জঙ্গলের অবস্থান ছিল এই দক্ষিণ এশিয়ায়। যদিও বর্তমানে এই খেতাব দক্ষিণ অ্যামেরিকার অ্যামাজন জঙ্গলের মাথায় উঠেছে। যাই হোক সুপ্রাচীন সেই জঙ্গলের বিশাল একটা অংশের অবস্থান ছিল ভারত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায়। প্রাকৃতিক কারণেই উপকূলীয় এলাকায় জঙ্গলের চেহারা ক্রান্তীয় বনের বদলে ম্যানগ্রোভ বনে পরিনত হয়। ম্যানগ্রোভ বনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই বনের উদ্ভিদগুলো দিনে একাধিকবার সমুদ্রে জোয়ারের কারণে নোনা পানিতে অর্ধেক ডুবে থাকে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ পুর্ব এশিয়ার উপকূলীয় এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই ম্যানগ্রোভ বনের খণ্ডিত কিছু ভগ্নাংশ এখনো টিকে আছে। ভারতের তামিলনাড়ু এবং অন্ধ্র প্রদেশের উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত ম্যানগ্রোভ বন দুটি সেই ভগ্নাংশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু বিলুপ্তপ্রায় সেই সুপ্রাচীন ম্যানগ্রোভ বনের টিকে থাকা সবচেয়ে বড় অংশটির নাম সুন্দরবন। বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চল এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুটি জেলা মিলিয়ে বিস্তৃত এই বনটি এখনো বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনের খেতাব ধরে রেখেছে। 


 

বাংলাদেশের খুলনা বিভাগ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা এই দুটো জেলা মিলিয়ে বিস্তৃত বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার। মোটা দাগে এর শতকরা প্রায় ষাট ভাগ বা ছয় হাজার বর্গ কিলোমিটারের মত এলাকা বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আর বাকি শতকরা চল্লিশ ভাগ বা চার হাজার বর্গকিলোমিটারের মত এলাকা ভারতের নিয়ন্ত্রণাধীন। জমি মাপজোকের প্রচলিত এককের হিসেবে এই সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ২৫ লাখ একর। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনের আয়তন মাত্র তিন হাজার একরেরও কম।

 

ভৌগলিক ভাবে এই সুন্দরবনের সীমানা দুটি নদী দিয়ে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। পুব দিকে ভারতের হুগলী নদী আর পশ্চিমে বাংলাদেশের বলেশ্বর নদ, এই দুটো জলধারার মধ্যবর্তী ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের আনুষ্ঠানিক নাম সুন্দরবন। এই বনাঞ্চলটির নামকরণ নিয়ে একাধিক মতবাদ প্রচলিত আছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ সমর্থনপুষ্ট মতবাদ অনুযায়ী সুন্দরী নামক এই বনের এক ধরনের গাছের নাম অনুসরণ করে সুন্দরবনের নাম রাখা হয়েছিল। তবে এর বিপরীতে কেউ কেউ বলেন সমুদ্রবন অথবা চন্দ্রবন নামটি অপভ্রংশের কারণে সুন্দরবনে পরিনত হয়েছে। 

 

উত্তরের হিমালয় পর্বতমালা থেকে নেমে আসা গঙ্গা, ব্রক্ষ্মপুত্র এবং মেঘনা এই তিনটি জলধারার মোহনা এই সুন্দরবন এলাকায় অবস্থিত। এই সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় প্রায় পঞ্চাশ হাজার বছর আগ থেকে মানুষের বসতি থাকলেও ইতিহাসে প্রথম এর উল্লেখ পাওয়া যায় তৃতীয় শতকের মাঝামাঝি সময়। প্রায় এক হাজার আটশ বছর আগে এখানে চাঁদ সওদাগর নামক এক ব্যক্তি একটি জনপদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রত্মতাত্বিকরা সুন্দরবনের বাঘমারা এলাকায় এই চাঁদ সওদাগরের হাতে গোড়াপত্তন হওয়া একটি প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছেন। এরপর এক হাজার বছরের বেশী সময় ইতিহাসের পাতায় এই বনাঞ্চলের উল্লেখ করা হয়নি। অবশেষে ত্রয়োদশ শতকে সূচিত মুঘল শাসনামলে আবারো এই সুন্দরবনের কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে মুঘল রাজবংশের তৃতীয় সম্রাট আকবরের শাসনামলে তার সেনাবাহিনীর আক্রমণ থেকে প্রাণ বাঁচাতে স্থানীয় অনেকেই গহীন সুন্দরবন এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। পলাতক এই মানুষগুলোর তৈরী করা বাসস্থানগুলো সপ্তদশ শতকে পর্তুগিজ জলদস্যুদের দখলে চলে যায়। এই আস্তানাগুলো থেকে তারা নিয়মিত মুঘল ভারতের বিভিন্ন জনপদে হামলা চালাতো। 

 

এখনো অনেক প্রান্তিক মানুষই এই সুন্দরবন ও তদসংলগ্ন এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে। এদের একটা বড় অংশের জীবিকা উপার্জনের একমাত্র উপায় মাছ শিকার। এর পাশাপাশি কিছু সম্প্রদায়ের মানুষ প্রতিবছর একটা নির্দিষ্ট সময় সুন্দরবন থেকে মৌমাছির মধু আহরনে ব্যস্ত থাকেন। এই পেশাটি বিশ্বের অন্যতম বিপদজনক পেশাগুলোর একটি। কারণ এই অভিযানে প্রতি পদক্ষেপে থাকে বাঘের খাদ্যে পরিনত হবার আশংকা। মহাশক্তিশালী এই প্রানীটির আক্রমণ থেকে বেঁচে গেলেও অধিকাশং ক্ষেত্রেই তার চিহ্ন বাকি জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। তবে এই বিপদ মোকাবেলায় অসাধারণ এক বুদ্ধি বের করেছেন মৌশিকারীরা। বাঘ এবং সিংহের মত শিকারী প্রাণীগুলো তাদের দিকে কেউ তাকিয়ে আছে টের পেলে সাধারণত আর হামলা চালায় না। যে কারণে বাঘ সবসময় তার শিকারের পেছন থেকে হামলা চালায়। সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের সময় মৌশিকারীরা তাদের মাথার পেছনে একটি মুখোশ বেধে রাখে। সেই মুখোশের চোখজোড়া তাকিয়ে আছে বলে মনে হওয়ায় মুখোশ ব্যবহারকারীর ওপর বাঘ হামলা চলানো থেকে বিরত থাকে। 

 

সুন্দরবন নামক বনাঞ্চলের ওপর প্রথম সার্ভে চালানোর কৃতিত্ব বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে রয়েছে। ১৭৫৭ সালে মুঘল বাদশাহ দ্বিতীয় আলমগীরের কাছ থেকে এই বনাঞ্চলের সত্বাধিকার লাভ করে বৃটিশ প্রতিষ্ঠানটি। যার ১২ বছরের মাথায় তারা সুন্দরবনের প্রথম সার্ভে প্রকল্প শুরু করে। জেনে অবাক হবেন স্থানীয়দের মধ্যে জনপ্রিয়তার কারণে সেই সার্ভে করা হয়েছিল ফার্সি ভাষায়। এর ধারাবাহিকতায় ১৮৬০ সালে এই বনাঞ্চলটির রক্ষনাবেক্ষনের জন্য ততকালীন বৃটিশ ইন্ডিয়ার বেঙ্গল প্রদেশে একটি বন বিভাগ চালু করা হয়। এই বিভাগের সদর দপ্তরটির অবস্থান ছিল বর্তমান বাংলাদেশের খুলনা জেলায়। 

 

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নিয়ে কথা বলতে গেলে অবধারিত ভাবে প্রথমেই যে প্রাণীটির কথা বলতে হবে সেটি রয়েল বেঙল টাইগার। আক্ষরিক অর্থেই রাজসিক এই প্রাণীটি তার হলুদের ওপর কালো ডোরাকাটা রঙের জন্য বিশ্বখ্যাত। এই প্রজাতির পূর্ণবয়ষ্ক পুরুষ সদস্যদের নাক থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত গড় দৈর্ঘ্য প্রায় দশ ফুট। তবে এর মধ্যে প্রাণীটির লেজের দৈর্ঘ্যই প্রায় তিন ফুটের মত। এদের গড় ওজন ২০০ থেকে ২৫০ কেজির মত হয়ে থাকে। তবে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় বাঘটির ওজন ছিল পুরো সোয়া তিনশো কেজি। প্রকৃতিতে এই প্রাণীগুলো নিভৃতচারী হয়ে থাকে। এরা বন্য শূকর, হরিণ এবং মহিষের মত প্রাণী শিকারের মাধ্যমে জীবন ধারণ করে। বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় আনুমানিক আড়াই হাজারের মত রয়েল বেঙল টাইগার রয়েছে। এর শতকরা দশ ভাগই সুন্দরবনে বসবাস করে। 

 

রয়েল বেঙল টাইগারের পাশাপাশি সুন্দরবনের বাসিন্দা বণ্যপ্রাণীদের মধ্যে রেসাস বানর, চিতল হরিন, ধূসর মাথা মেছো ঈগল, নীল মাছরাঙা, নোনাপানির কুমির এবং করাতমাছ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ইরাবতী ডলফিন নামক এক প্রজাতির জলচর স্তণ্যপায়ী প্রাণীও সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী নালায় বসবাস করে। তবে নদী দূষণের কারণে এদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। বাঘের মত এই বনে বসবাসকারী অনিন্দ্যসুন্দর চিতল হরিনের অস্তিত্বও হুমকির মধ্যে রয়েছে। একসময় পুরো সুন্দরবনে কয়েক লাখ হরিন ঘুরে বেড়ালেও বর্তমানে এই সংখ্যা কমে ত্রিশ হাজারে নেমে এসেছে। আর এই বনাঞ্চল থেকে এরিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীর তালিকায় রয়েছে জাভান রাইনোসরাস নামক এক প্রজাতির শিংবিহীন গন্ডার। 

 

উদ্বেগের বিষয় হলো, বিভিন্ন কারণে সুন্দরবনের আয়তন ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। দুইশ বছর আগেও বৃটিশদের পরিচালিত সার্ভে অনুযায়ী এই বনাঞ্চলের আয়তন ছিল প্রায় ১৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার বা ৪২ লাখ একরের বেশী। এই সংকোচনের পেছনে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং মানব আগ্রাসনের পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও হাত রয়েছে। বিশেষ করে ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় প্রায় প্রতি বছরই একাধিক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। আর কয়েক বছর পরপরই মহাশক্তিশালী একেকটি ঘূর্ণিঝড় এই এলাকায় তান্ডব চালিয়ে যায়। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৭ সালে এক ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতেই সুন্দরবনের শতকরা ৪০ ভাগ উজাড় হয়ে যায়। সেই ক্ষতির মাত্রা পুরোপুরি বুঝে ওঠার আগেই দুই বছরের মাথায় এই বনাঞ্চলে ফের আঘাত হানে আইলা নামের বিধ্বংসী আরেকটি ঘূর্ণিঝড়। ঐ ঝড়েও সুন্দরবনে বিদ্যমান জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

 

প্রাকৃতিক কারণের মত সুন্দরবন ধ্বংসে মানবসৃষ্ট কারণের ভূমিকাও অনেক। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির বিষয়টি। ২০০৭ সালে ইউনেস্কো পরিচালিত এক গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ প্যারিস জলবায়ু চুক্তির শর্তগুলো পূরণে ব্যর্থ হলে এই শতকের শেষ নাগাদ বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা ৪৫ সেন্টিমিটার বা দেড় ফুট পর্যন্ত বেড়ে যাবার আশংকা রয়েছে। তেমনটা হলে সুন্দরবনের শতকরা ৭৫ ভাগই হারিয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।

 

এছাড়া সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত একাধিক জলধারা গুরূত্বপূর্ণ নৌপথ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যার ধারাবাহিকতায় মাঝে মধ্যে এই পথে চলাচলকারী পণ্যবাহী জাহাজ দুর্ঘটনাও ঘটে। ২০১৪ সালে এই বনের সেলা নদীতে সাউদার্ন স্টার সেভেন নামের একটি পন্যবাহী জাহাজ ডুবে গিয়েছিল। দুর্ঘটনার সময় জাহাজটিতে সাড়ে তিন লাখ লিটারের বেশী ফার্নেস অয়েল ছিল। দুর্ঘটনার পর সেই জ্বালানী তেল প্রায় সাড়ে তিনশো বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের বিপুল ক্ষতি হয়েছে বলে ধারনা করা হয়। 

 

তবে আশার ব্যাপার হলো রয়েল বেঙল বাঘ এবং তার কারণে সুন্দরবন সংরক্ষণের প্রতি স্থানীয় মানুষের আগ্রহ রয়েছে। বাংলাদেশ এবং ভারত দুটো দেশই এই বাঘকে তাদের জাতীয় প্রাণীর মর্যাদা দিয়েছে। তাই আশা করা যায়, জাতীয় প্রাণী ও তার বাসস্থান বাঁচাতে দুটো দেশই তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। আর তাদের সম্মিলিত চেষ্টার ফলে অনন্য এই বনাঞ্চলটি রক্ষা পাবে এমনটাই আশা বিশ্ববাসীর।

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!