হাং সন ডুং
আজ থেকে প্রায় এক লাখ বছর আগে মানুষ প্রথম আফ্রিকা মহাদেশ ছেড়ে এশিয়া, ইউরোপ
এবং অস্ট্রেলিয়ার মত বিশ্বের অন্যান্য স্থলভাগগুলোয় বসতি স্থাপন শুরু করেছিল। বিজ্ঞানের
ভাষায় প্রস্তর যুগ নামে পরিচিত ঐ সময়ে বিভিন্ন গুহা, আদিম মানুষের অভিবাসন প্রক্রিয়ায়
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ ঝড় বা বৃষ্টির মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর রাতের অন্ধকারে
হিংস্র প্রাণীর শিকারে পরিনত হওয়া থেকে বাঁচতে তখন এই গুহাগুলোই ছিল মানুষের একমাত্র
আশ্রয়স্থল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় আধুনিক মানুষের কাছে সেই গুহাগুলোর অধিকাংশই এখন
অনাবিষ্কৃত অবস্থায় রয়েছে। অবশ্য বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির অগ্রযাত্রার কল্যাণে বিশ্বের
বিভিন্ন স্থানে নিয়মিতই নতুন নতুন গুহা আবিষ্কার করা হচ্ছে। যার ধারাবাহিকতায় মাত্র
এক দশক আগে বিশ্বের বৃহত্তম গুহাটির খোজ পাওয়া যায়। এখণ পর্যন্ত আবিষ্কৃত গুহাগুলোর
মধ্যে উচ্চতা, দৈর্ঘ্য এবং আয়তনের হিসেবে বৃহত্তম এই গুহাটির অবস্থান ভিয়েতনামে। প্রতিবেশী
লাওসের সাথে দেশটির সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত কুয়াং বিন প্রদেশে বিদ্যমান এই গুহার ভেতর
প্রথম মানুষর পদচিহ্ন পড়ে ২০০৯ সালে। কারণ এই গুহার প্রবেশ পথ এতটাই দুর্গম যে একবিংশ
শতকের আগে মানুষের কাছে এমন দুর্গম গুহায় প্রবেশ করার মত উপযুক্ত প্রযুক্তিই ছিল না।
স্থানীয় ভাষায় এই গুহাটির নাম হাং সন ডুং। যা বাংলা করলে দাঁড়ায় পাহাড়ী নদীর গুহা।
পৃথিবীর ভেতর আরেক পৃথিবী
বর্তমানে ভিয়েতনাম - লাওস সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম
গুহা হাং সন ডুং এর সৃষ্টি হয়েছিল আনুমানিক বিশ থেকে পঞ্চাশ লাখ বছর আগে। সৃষ্টির
সময়কালে পুরো ত্রিশ লাখ বছরের তফাত থাকার কারণ এই ধরণের গুহা সৃষ্টির প্রক্রিয়া।
বিজ্ঞানের ভাষায় এ ধরণের গুহাকে
সলিউশনাল কেইভ বলা হয়। কারণ পানিতে পাহাড়ের লাইমস্টোন বা চুনাপাথর দ্রবীভূত হওয়ার
ফলে এ ধরণের গুহার সৃষ্টি হয়। সাধারণত বৃষ্টি বা নদীর পানির কারণে এমনটা হয়ে থাকে।
ভূপৃষ্ঠের মাটি চুইয়ে ভূগর্ভস্থ চুনাপাথরের স্তরে পৌঁছানোর আগে সেই পানিতে বাতাসের
কার্বন ডাই অক্সাইড মিশ্রিত হয়। যার ফলে ঐ পানির অম্লতা বেড়ে যায়। যাতে চুনাপাথর
সহজেই দ্রবীভূত হয় এবং পাহাড়ের অভ্যন্তরভাগ ক্ষয়ে এমন গুহার রুপ ধারণ করে। এই পুরো
প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ করতে লাখ লাখ বছর সময় লেগে যায়। হাং সন ডুং গুহাটির ক্ষেত্রে
প্রায় পঞ্চাশ লাখ বছর আগে শুরু হওয়া এই প্রক্রিয়াটি শেষ হয়েছিল আনুমানিক বিশ লাখ
বছর আগে। অবশ্য যে চুনাপাথর দ্রবীভূত হয়ে বিশাল এই গুহার সৃষ্টি হয়েছে তার বয়স
কিন্তু পঁচিশ কোটি বছরেরও বেশী।
হাং সন ডুং গুহাটির আয়তন প্রায় তিন কোটি পঁচাশি লাখ ঘণ মিটার।
অর্থাত এটি আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত বিশ্বের বৃহত্তম গুহা হিসেবে পরিচিত মালয়েশিয়ার
ডিয়ার কেইভ নামক গুহাটির আয়তন এর অর্ধেকেরও কম। গুহাটির দৈর্ঘ্য পাঁচ দশমিক ছয়
মাইল বা নয় কিলোমিটারের বেশী। এই দৈর্ঘ্যজুড়ে গুহাটির গড় উচ্চতা দুইশো মিটার বা
সাড়ে ছয়শো ফুটের বেশী। তবে এর মেঝে থেকে ছাদের সর্বোচ্চ দূরত্ব পাঁচশো মিটার বা এক
হাজার ছয়শো ফুটের বেশী। গুহাটির দুটো প্রবেশ পথ বেশ দূর্গম হলেও ভেতরে এটি বেশ
প্রশস্ত। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হাং সন ডুঙের গড় প্রস্ত দেড়শো মিটার বা প্রায়
পাঁচশো ফুট। যে নদীর কারণে গুহাটির সৃষ্টি হয়েছিল সেটি এখনো এই গুহার ভেতরে
প্রবাহিত হচ্ছে। কিছু জায়গায় এই নদীর স্রোত এত তীব্র যে কোন অবলম্বন ছাড়া তা পার হওয়া
অসম্ভব। আবার গুহাটির কিছু জায়গায় এই নদী এতটাই শান্ত যে তা সুইমিং পুল হিসেবেও
ব্যবহার করা সম্ভব। এই গুহার আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর ভেতর দুটো বিশাল
সাইজের ডলিন রয়েছে। একটি ভূগর্ভস্ত গুহার ছাদের একাংশ কোন কারণে ধসে গিয়ে গুহাটির
যে এলাকায় সুর্যের আলো এবং বৃষ্টির পানি সরাসরি প্রবেশ
করতে পারে তাকে ডলিন বলা হয়। ভূগর্ভস্থ গুহাগুলোর জীববৈচিত্র্য বেশ সাদামাটা হলেও এই
ডলিনগুলোয় বাহারী জীববৈচিত্র্যের দেখা পাওয়া যায়।
সাধারণত ভূগর্ভস্থ গুহাগুলোর দৈর্ঘ্য তিন থেকে চার কিলোমিটারের
বেশী হয় না। কারণ দৈর্ঘ্যের সাথে সাথে গুহাটির ছাদের ভরও বাড়তে থাকে। ভেতরটা ফাঁপা
হওয়ায় একটা নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের পর গুহার দেয়ালের পক্ষে আর ছাদের সেই ভার বহন
সম্ভব হয় না। অথচ ভিয়েতনামের এই হাং সন ডুং গুহাটির দৈর্ঘ্য স্বাভাবিকের তুলনায়
দুই গুনেরও বেশী। একাধিক পরীক্ষা নিরিক্ষা চালিয়ে অবশেষে এই ব্যতিক্রমের কারণ
খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। হাং সন ডুং এর রেকর্ডধারী দৈর্ঘ্যের কারণ মূলত এই গুহার
খাড়া দেয়াল। মেঝের সাথে সমকোনে দাঁড়িয়ে থাকায় এই দেয়ালগুলো স্বাভাবিকের তুলনায়
বেশী ভার বহনে সক্ষম। এর ফলেই হাং সন ডুং বিশ্বের বৃহত্তম গুহার খেতাব অর্জন করেছে।
বর্তমানে ভিয়েতনামের একটি জাতীয় উদ্যানের অংশ এই গুহাটি প্রথম
আবিষ্কার করেন স্থানীয় এক রাখাল। হো খান নামের সেই রাখাল ১৯৯০ সালের এক দুপুরে ঝড়
বৃষ্টির সময় এই গুহার প্রবেশ পথে আশ্রয় নেন। হো খানের ভাষ্য অনুযায়ী সেদিন তিনি
গুহাটির ভেতর থেকে জোরালো গর্জন শুনতে পেয়েছিলেন। সেই সাথে একটু পর পর গুহার ভেতর
থেকে মেঘের মত কুয়াশাও বেরিয়ে আসছিল। সব মিলিয়ে ভয় পেয়ে যাওয়ায় ঝড়ের মধ্যেই ঘরে
ফিরে আসেন হো খান। তারপর প্রায় দুই দশক ঐ গুহাটির কথা ভুলেই ছিলেন তিনি। এরপর ২০০৯
সালে বৃটিশ কেইভ রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন সেখানে বড় গুহার খোঁজে একটি সার্ভে করার
সিদ্ধান্ত নেয়। সেই খবর পেয়ে হো খান সার্ভেকারী দলের সদস্যদের সাথে দেখা করেন এবং
উনিশ বছর আগে খুঁজে পাওয়া গুহাটির কথা তাদের জানান। হো খানের দেখানো পথ ধরেই
সার্ভেকারী দলটি হাং সন ডুং পর্যন্ত পৌঁছুতে সক্ষম হয়।
বৃটিশ সেই সার্ভে দলের নেতৃত্বে ছিলেন হাওয়ার্ড লিম্বার্ট।
অভিজ্ঞ এই গুহাচারী এর আগেও একাধিক বড় গুহা সার্ভে করেছেন। ২০০৯ সালে হাং সন ডুং
গুহায় তার প্রথম অভিযান দ্বিতীয় মুখের এক কিলোমিটার আগেই থেমে যায়। কারণ সেখানে
গুহাটির মেঝে থেকে দুইশো ফুটের বেশী উচু একটি নরম এবং পিচ্ছিল পাথরের দেয়াল রয়েছে।
ফ্লোস্টোন নামে পরিচিত এ ধরণের পাথর বেড়ে উঠতে গেলে তা খসে পড়ে যায়। তাই উপযুক্ত
সরঞ্জাম ছাড়া এ ধরণের দেয়ালে চড়া সম্ভব হয় না। পরের বছরেই আবার হাওয়ার্ড ও তার দল
উপযুক্ত সরঞ্জামসহ এই গুহায় ফিরে আসেন এবং পুরো গুহাটির সার্ভে সম্পন্ন করেন। সেই
থেকে গত দশ বছরে হাওয়ার্ড এই গুহাটি একশো বারের বেশী অতিক্রম করেছেন। এমনকি সেখানে
পর্যটন ব্যবসার সাথেও তিনি সস্ত্রীক জড়িয়ে গেছেন। হাং সন ডুং গুহায় পর্যটন
সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে ভিডিওটি শেষ পর্যন্ত দেখতে ভুলবেন না।
হাওয়ার্ড লিম্বার্টের দ্বিতীয় অভিযাত্রী দলের সদস্যদের মধ্যে
একাধিক জীববিজ্ঞানীও ছিলেন। গুহাটির মধ্যে থাকা ডলিন দুটোয় তারা বিপুল সংখ্যক
উদ্ভিদ প্রজাতির সন্ধান পেয়েছেন। ভূগর্ভস্থ সেই জঙ্গলে বাইরে থেকে শুধু কয়েখ
প্রজাতির বানরই প্রবেশ করতে পারে। গুহার দুইশো মিটার উচু দেয়াল বেয়ে ওঠা নামা এসব
বানরের জন্য কোন ব্যাপারই না। জঙ্গলের মেঝেতে ঘুরে বেড়ানো সুস্বাদু শামুকের খোঁজে
প্রায়ই বানরগুলো এখানে আসে। আর এই জঙ্গলের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে রয়েছে বিভিন্ন
প্রজাতির সরীসৃপ, বাদুড়, কাঠবিড়ালী, ইদুর এবং পাখি। এছাড়া প্রাণী জগতের নতুন সদস্য
হিসেবেও কয়েকটি প্রজাতিও আবিষ্কার করেছেন তারা। যার মধ্যে আছে মাছ, কাকড়া বিঁছা,
চিংড়ি এবং কাঠউকুন। গুহার ভেতর অন্ধকারে স্থায়ীভাবে বসবাস করায় এদের প্রায় সবারই
গায়ের রঙ স্বচ্ছ এবং অনেকেরই কোন চোখ নেই। বিষয়টিকে অন্ধার গুহায় বিবর্তনের
স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
ভূপৃষ্ঠের এতটা গভীরে অবস্থান হওয়ায় হাং সন ডুং গুহার ভেতরর
আবহাওয়া ব্যবস্থাও বাইরে থেকে আলাদা। অনেক সময় বাইরে আকাশ মেঘমুক্ত হলেও গুহার
ভেতর বাড়তি আর্দ্রতার কারণে হাং সন ডুং এর ছাদ মেঘে ঢাকা থাকে। ১৯৯০ সালের সেই
ঝড়ের দুপুরে তেমন মেঘই বেরিয়ে আসতে দেখেছিলেন হো খান। ভূগর্ভস্থ এই মেঘের কারণে
হাওয়ার্ড লিম্বার্টের সার্ভেও বেশ কয়েক দফা বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল।
২০১৯ সালে এসে নতুন করে রেকর্ড গড়ে এই হাং সন ডুং। পেশাদার
ডুবুরির একটি দল ঐ বছর এপ্রিল মাসে এই গুহায় অভিযানে অংশ নেন। তারা আবিষ্কার করেন
হাং সন ডুং একটি ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের মাধ্যমে নিকটবর্তী হাং থুং নামে আরেকটি গুহার
সাথে সংযুক্ত। বছরের বারো মাসই অবশ্য এই সুড়ঙ্গটি পানিতে ডুবে থাকে। তাই পেশাদার
ডুবুরি ছাড়া এটি আবিষ্কার সম্ভব ছিল না। নতুন এই গুহাটির সাথে সংযুক্ত হওয়ায় হাং
সন ডুঙের মোট আয়তন এখন প্রায় চার কোটি ঘণ মিটার।
এত বড় হওয়া সত্বেও হাং সন ডুং আর বেশী দিন বিশ্বের বৃহত্তম
গুহার খেতাবটি ধরে রাখতে পারবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। স্যাটেলাইট
প্রযুক্তির কল্যাণে এখণ বড় গুহা আবিষ্কারের হার বেড়ে গেছে। এই কাজে জড়িতদের ধারণা
অনুযায়ী দক্ষিণ অ্যামেরিকার অ্যামাজন জঙ্গলের মধ্যে হাং সন ডুঙের চাইতেও বড় গুহার
অস্তিত্ব থাকার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
আবিষ্কারের চার বছর পর অর্থাত ২০১৩ সাল থেকে গুহাটি পর্যটকদের
জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ভিয়েতনামের আইন অনুযায়ী প্রতিবছর ফেব্রুয়ারী থেকে
আগস্ট পর্যন্ত চলা পর্যটন মৌসুমে সর্বোচ্চ এক হাজার পর্যটক এই গুহাতে প্রবেশ করতে
পারবেন। হাং সন ডুঙের অনন্য পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণেই এমন সীমা বেধে দেয়া
হয়েছে। এই গুহা পরিদর্শনে মাথা পিছু তিন হাজার ডলারের মত খরচ হবে। ধীরে ধীরে
ভিয়েতনামের এই এলাকা পর্যটকপ্রিয় হয়ে উঠছে। যাদের চাহিদা মেটাতে ভিয়েতনাম সরকার
গুহাটির ভেতর প্রায় সাড়ে দশ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ক্যাবল লাইন স্থাপনের পরিকল্পনা
হাতে নিয়েছে। প্রায় বিশ কোটি ডলারের এই প্রকল্পটি অবশ্য পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদের
মুখে স্থগিত অবস্থায় আছে। প্রতিবাদকারীদের দাবী, যে যুক্তিতে প্রতিবছর এক হাজারের
বেশী পর্যটক ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না, সেই একই যুক্তিতে এখানে ক্যাবল লাইন স্থাপনও
অনুচিত কাজ হবে। আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বর্ষা মৌসুম চলায় এই গুহায় প্রবেশ
করা সম্ভব হয় না।